Modern dress
রণজিৎ গুহ, সমাজকর্মী ও লেখকঃ বিশ্বজুড়ে নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান। এই পরিধান বা আমাদের পোশাক পরিচ্ছদ অনেক সময়ই আমাদের পেশাগত, জাতিগত বা ধর্মীয় পরিচয় বহন করে। মহিলা ও পুরুষের পোশাক প্রায় সব দেশে বা সব জাতির আবশ্যিক ভাবে আলাদা। কিছু কিছু পেশার নির্দিষ্ট পোশাক অবশ্য স্ত্রী পুরুষ ভেদে সাধারণ ভাবে আলাদা করা হয়না।খুব মৌলিক তফাৎ না থাকলেও আমাদের ঘরের ও বাইরের পোশাক কিছুটা আলাদা হয়ই। আটপৌরে পোশাকে যেমন উৎসব অনুষ্ঠানে যাওয়া হয় না।আবার অনুষ্ঠান ভেদে একই পরিধানের পরণের ঢং রঙ বদলে বদলে যায়। বিয়ে বাড়িতে পোশাকের যে ঔজ্জ্বল্য তাতো শোক আবহে মানানসই নয়। বাঙালির পোশাকের আদি বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করা এখন বেশ কষ্টসাধ্য।প্রাকবৌদ্ধ যুগের গৌড়বঙ্গ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের পোশাক কেমন ছিল তার প্রকৃতপক্ষে কোনও পাথুরে প্রমাণ নেই।রাজরাজড়া বা দেবদেবীর অস্পষ্ট কিছু পরিচ্ছদ ধারণা করা যায় বড়জোর। এই অঞ্চলে বুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সাধারণত এক বস্ত্রীয় পোশাকের চল ছিল।সমগ্র দক্ষিণ এসিয়াতেই সেলাই বিহীন একবস্ত্র পরার চল।কোথাও কোথাও শৌখিন কম দৈর্ঘের দ্বিতীয় বস্ত্রখণ্ড কাঁধে বা গলায় রাখার চল ছিল।প্রাচীন বা অতি প্রাচীন সময়ের কথা না হয় মুলতবি থাক।বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত রামমোহন বিদ্যাসাগর বা বঙ্কিমচন্দ্র রামকৃষ্ণ এবং রবীন্দ্রনাথের পোশাক ভাবনায় বাঙালির পোশাক বৈশিষ্ট্য কতটা? প্রাথমিক ভাবে পোশাক পরিচ্ছদ এর ধরণ ও উপাদান পুরোপুরি স্থানিক আবহ পরিবেশের ওপর নির্ভর করে।খানিকটা জীবিকা নির্ভরও বটে।আবার জীবিকাও প্রকৃতি নির্ভর উদ্ভাবনা।আমাদের খাদ্য খাওয়াও তাই।পোশাক প্রধানত আব্রু রক্ষার জন্য। মানুষের স্বাভাবিক শিল্পবোধ তার অতি আবশ্যিক অন্ন বস্ত্র বাসস্থানকে নিতান্ত প্রয়োজনের বাইরে এক শোভন সুষমা দেওয়ার চেষ্টা করেছে বরাবর । প্রাত্যহিক জীবনাচরণের অবসরে সৌন্দর্য সৃষ্টিতে ব্যাস্ত থেকেছে। পোশাক প্রয়োজন ছাড়িয়ে পেশা বা ঐতিহ্যের প্রতীক হয়েও দাঁড়িয়েছে।সাধারণ্যের পোশাক ও অভিজাতদের পোশাক হিসাবে বিভাজিতও হয়েছে। রামমোহন মুঘল অভিজাত ও ইউরোপীয় পোশাকের এক বিচিত্র মিশেলে নিজেকে অনন্য রাখতেন।বঙ্গজ পরিধানে মাথায় আলাদা বস্ত্রের চল ছিলনা। সেই সময়ে মুঘল ও বৃটিশদের শিরস্ত্রান এর অনুকরণে ভারতীয় অভিজাতরাও অনেকেই দেশী পাগরি জাতীয় শিরস্ত্রান ব্যাবহার করতেন।সাধারণত খাঁটি নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত বাঙালির পোশাক পরতেন বিদ্যাসাগর। ক্রমে এই পোশাক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের পরিচিতি হয়ে দাঁড়ায়। এই পোশাকের নানান রকমফের পরবর্তী প্রায় পৌনে দুশো বছর বাঙালি পুরুষদের মধ্যে জনপ্রিয় থেকেছে। স্বল্পবিত্ত উচ্চবিত্ত সকলেই প্রায় ধুতি পাঞ্জাবি ধুতি সার্টে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছিলেন। বঙ্গসংস্কৃতির অন্যান্য আচরণের মত পোশাক রীতিতেও জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অসামান্য প্রভাব ছিল।বাঙালি পুরুষদের পোশাক নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে ঠাকুর বাড়িতে।সেসময়ে সব অভিজাত বাঙালি পরিবারে সম্ভ্রান্ত মুসলমানি পোশাকের চল ছিল। বিলেতি পোশাকের আগ্রহে পরিবর্তনও হচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথের সময়েই আপাদমস্তক স্বদেশী সাজ পোশাক নিয়ে অনেকেই উৎসাহ দেখান।তবে সাধারণ ভাবে উৎসব অনুষ্ঠানে ঠাকুরবাড়িতে পুরুষদের পোশাক ছিল গরদের ধুতি, জমকালো পিরান,গায়ে শাল/চাদর, মাথায় পাগড়ি বা টুপি পায়ে চটি। বাঙালি মহিলাদের পোশাকের আধুনিক চলনের শুরুও ঠাকুর বাড়িতে। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী মুম্বাই থেকে শিখে এসেছিলেন আধুনিক কায়দায় শাড়ি পরার ঢং৷পরবর্তীতে শাড়ি পরার ধরনে কিছুটা পরিবর্তন এলেও কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরার এই কায়দাটি এবং বাঁ দিকে আঁচল রাখার ঢং বদলায়নি এতটুকুও৷
জ্ঞানদানন্দিনীই শুরু করেছিলেন শাড়ির সাথে সেমিজ বা ব্লাউজ পরার সূচনা। গত ২৫/৩০ বছরে বাঙালি নারী পুরুষের পোশাক পরিধান অনেকটাই বদলে গেছে। একটা জাতির খাদ্য খাওয়া, পরিচ্ছদ, চলন বলন প্রযুক্তির কল্যাণে পাল্টে পাল্টে যায়ই। তদোপরি পণ্য উৎপাদকরা নিজেদের সুবিধার্থে বৈচিত্র্যকে নিরুৎসাহিত করে। সকলের এক পোশাকের প্রতি আগ্রহ তৈরির হাজারো বাণিজ্যিক কৌশল নেয়।আমাদের ভুলিয়ে দেয় কোন আবহাওয়ায় কেমন পরিধান প্রকৃত শরীর বান্ধব।জাতির পোশাক পরিচিতিকে আমরা আমলই দিই না।আমাদের খাদ্যাভ্যাস ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমাদের খেলাধুলা আমাদের গানবাজনা আমাদের অন্য সকল স্বাভাবিক বিনোদন। অর্থাৎ জাতিগত সাংস্কৃতিক পরিচয়টাই নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। আমরা কখনও সর্বভারতীয় বা আন্তর্জাতিক হওয়ার আহ্লাদে, নিজস্ব অবহেলায়,ঔদার্যের নামে উদাসীনতায় এক ঐতিহ্যহীন পরম্পরাহীন নিজস্ব জোরালো সংস্কৃতিহীন শিকড়হীন বৈশিষ্ট্যহীন জাতিতে পরিনত হচ্ছি। শিকড়হীন জাতিকে পদানত করতে অনুগত করতে সব শক্তিরই সুবিধা।




Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours