জীবন রায়, প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ, রাজ্যসভাঃ
রক্ত ঘাম আর চোখের জলের সাত-সমুদ্র সাতার কেটে একজন সত্যের সমকালিন অভিমুখে্র অন্তত ঝিলিকটা খুজে পেয়েছেন বলে যদি মেনে থাকেন, শেষ-মেষ ---- এই শেষমেষের একটা অন্ত তাকে খুজতেই হোত, নিজেতেই জীবনের শেষ প্রহরে। তাকে ভাবতেই হোত, --- যা পাওয়া গেল, তাকে কেমনভাবে বিনিয়োগ করে যাওয়া হবে, জীবনান্তে কোন শেষ রিকল্পনায়, প্রজন্মান্তরের পথে। শরীর সর্বস্বতার দানবটা যখন আকাশকেও গ্রাস করতে চাইছে, তখন বস্তুর ভাবগত দিক নিয়ে যাই বলুন কিংবা করুন --- সেগুলি যে রাহুগ্রাসের কবলে পরে যাবে, এমন কি নিজের ঘরেও, সেটা জেনেও বলতে হয়, ---- সব কিছুর বিনাশ আছে, ভাবের কখনো নয়, তার অধিষ্ঠান যে গতির মহাশক্তির কোলে। সেখান, রাহুর গ্রাস যেমন রয়েছে, মুক্তিটাও রয়েছে মহাকালের অভিমুখে। এই বোঝাটাকেই যখন যদি জীবনের সব থেকে বড় পাওনা বলে চিনে থাকি, তখনই মনে হয়, --- পার্থিব চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে যারা জীবনটাকে কাটিয়ে দিয়ে, সঞ্চিত টাকা-কড়ি ভাগ করতে গিয়েও, অংক মিলাতে আর না মিলাতেই যখন একটা চরম অন্ধকারকে সামনে রেখে শেষ নিশ্বাস ছেড়ে দিচ্ছেন ---- তার চাইতে সেই এক রত্তিছেলে, যার রক্ত- সম্ভ্রান্ততার অনেকটাই মুছে গিয়েছিলো পদ্মার জলের ঢেউ এ ঢেউ এ, সেই আটবছর বয়সেই , তারপর চরম দারিদ্রতার দেওয়াল ফুটো করে যখন আকাশ খুজে পেলো, সেখানেও প্রবঞ্চনা, নিজের মধ্যে এবং বাইরে বিশ্বের প্রত্যন্ত কোন পর্য্যন্ত ---- সে আজ কিছু বলে যাওয়ার স্পর্ধা দেখাতে পারছে, মহাকালের অভিমুখে, হোক না তা তুচ্ছতা তুচ্ছ - 'বালির এক কনার' ইতিহাস। এই ইতিহাসে, যখন দারিদ্রতা আর মফস্মলের অল্প শিক্ষার মননকে মেট্রোপোলিশের ইংরাজীয়ানার অহংকারের পর্বতকে পথ করে চলতে হয়েছে, সে কালে পরিবারের কথায় - উচ্চ ব্রাহ্মন বংশের - ছেলেকে যখন নিজ জীবনে একের পর এক, ব্রাহ্মন্যবাদের হিংস্রতাকে অতিক্রম করতে হয়েছে, ঘড়ে ও বাইরে এবং এমণ কী বাইরের সেই কোনাটায় যাকে ঘড় বলে মেনেছিলাম সেখানেও ------- মনে হোত, যেন দীর্ঘ কারবাস, শারিরীক ভাবে খুন হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক থেকেও যেন ভয়ংকর। শেষ প্রান্তে তো দেখলাম, বিশ্বজ্ঞানের অবোধ সব ধারনা এক হয়ে গিয়ে ---, চারদিক থেকে চ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করছে তখন যেন বিশ্বটাই অন্ধকার লাগতো । বাঁচিয়ে দিলো আমায় রবীন্দ্রনাথ আর নিকোলাই অস্ট্রোভক্সি। নিকোলাই ছিলেল , বিশ্বের মহাপ্রথম মানবিক বিপ্লবের সময়, রাসিয়ার কয়লার ইঞ্জিনের সহ-রেলচালক। তিনি দু'খন্ডে 'ইস্পাত' লিখতে গিয়ে অন্ধ হয়ে গেলেন। ----- সেই চেষ্টাকে খুজে পেয়েছিলাম, 'শব্দজ্ঞানের অহংকার এবং শ্রমের প্রতি সুপ্ত ঘৃ্নার বলিষ্ট প্রতিবাদ। ইতিমধ্যে, অনুভুতির কোনায় কোনায় বুঝেছিলাম, বর্ণ ঘৃনা - এদেশে 'শ্রমের' উপরে যেভাবে আরোপিত, তা সাধারন ভাবের গতি থেকেও বুঝি তিভ্রতা পেয়েছে। অনেক সময় নিজেতেও আবিস্কার করেছি, বোধ জীবন রায়ের মধ্যেও এই ঘৃণা বোধ সুপ্ত ভাবে থেকে গেছে। নিকোলাই পড়ে সোভিয়েতে ' অর্ডার অফ লেনিন পেয়েছিলেন'। এইভাবে, মনুষ্যত্বের প্রতি অবমাননাবোধই জীবন রায়কে লিখতে শেখায় জীবন পণ করতে হয়েছে। এইভাবে নিকোলাইকে, লেখা-লেখির জীবনে আদর্শ হিসেবে মেনেছি। সেই বোধ থেকে - টাকা-পয়সার হস্তান্তর প্রকৃয়া যদি জীবনাভ্যাস বলে বিবেচিত হয়, বৌ্দ্ধিক শক্তির কণা মাত্র হস্তান্তর প্রকৃয়াটা উভয় প্রান্তেই ভয়ংকর বলে বুঝেছি । অনুভূতির কোনায় কোনায় গিয়ে, যা আছে তাকে ভেংগে দুমরে যদি নতুনের অনুপ্রবেশের সুগোগ করে নেওয়া যায় । ভাবের আবাস নির্মান অসম্ভব। সেখানে, লিখতে শেখাটা বাধ্যতামুলক। এখানেও নিকোলাই যদি আমার রক্ত মাংশের নায়ক হয়ে উঠে থাকেন, তবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মার্ক্সের পাশে থাকা ভাবজগতের অন্য এক সূর্য্য। তিনি লিখছেনঃ " হেতায় হোথায় পাগলের প্রায় ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায়-- বাহিরিতে চায়, দেখিতে না পায়, কোথায় কারার দ্বার। কেন রে বিধাতা পাষাণ হেণ, চারি দিকে তার বাঁধন কেন! ভাঙ্ রে হৃদয় ভাঙ্ রে বাধন সাধ্ রে আজিকে প্রাণের সাধন, লহরীর পর লহরী তুলিয়া" প্রশ্ন উঠবে, এতো কথা কেন, এতো কেন কবিতা বা গান।
দাবী করছি নাকো, জীবনের প্রান্তসীমায় দাড়ীয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। তবু বুঝেছিঃ যতটুকু পেয়েছি, তা দিয়েই পাওয়ার আকাংখ্যাটা শেষ হওয়া উচিত। সেটাকেই বুঝেছই 'মৃত্যুর' প্রস্তুতি নেওয়ার সময় হয়েছে। সে কথাটা অন্ততঃ বলে যাওয়া প্রয়োজনঃ সাম্য অভিষ্ট হলেও, ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে সেটা এখন কল্পনা থেকেও অনেক দূরে, কিন্তু বর্তমানকে তার সূর্য্যশিখার সামনে, যে বিশ্ব উচ্চতার কথা তাকে, ভাবতে হয় ----- সেটা তো বলে যেতেই হবে। সেটাই শেষ কথা বলে আমি মেনেছি। সে সত্যে্র বাইরেও সত্য আছে জেনেও, বুঝেছি হয়তো বা বর্তমানের এই সত্যটা অন্যের কাছে নেই, মৃত্যুর পরিকল্পনাটা এই সুত্রেই বাধা। রবীন্দ্রনাথের শেষ কবিতার শেষ কটি প্রাসংগিক লাইন দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। "সত্যেরে সে পায় আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে। কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে, শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে আপন ভান্ডারে। অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে সে পায় তোমার হাতে শান্তির অক্ষয় অধিকার।"
Post A Comment:
0 comments so far,add yours