সেঁজুতি ভট্টাচার্য, সমাজকর্মী, কলকাতাঃ ১. আমি বরাবরের মাঝারি। মেধা, বুদ্ধি, যোগ্যতা আর তারপর কর্মজীবন সব গড়পড়তা। আমার এই মধ্য মেধা আর সাদামাটা কর্মজীবন যেন আমার সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত না হয়। সে হয়ে উঠুক আমার সারা জীবনের একমাত্র সাফল্য- লেখাপড়া আর কেরিয়ার সবেতেই একেবারে এ প্লাস। তবেই তো তৃপ্তি, গর্ব আর এই অকিঞ্চিৎকর পরিচয় থেকে মুক্তি। ওর কৃতিত্বই ঢেকে দেবে আমার ব্যর্থতার অন্ধকার।
২. আমি ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। নামী স্কুল, প্রথম সারির ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, নামজাদা বি স্কুল হয়ে এখন যাকে বলে 'সাকসেসফুল কেরিয়ার'। আমার সন্তান তো ভালো হবেই। নয়তো সমাজে, পরিবারে আমার মুখ থাকবে নাকি?
আমাদের চারপাশেই রয়েছেন এইরকম সব অভিভাবক। এদের উচ্চাশা, আকাঙ্ক্ষা সব তাদের সন্তানদের সাফল্য নিয়ে। আর এই উচ্চাশা চাপই নবীন মনকে করে তুলেছে ভারাক্রান্ত, বিষন্ন। পরীক্ষা, প্রতিযোগিতা আর নম্বর সর্বস্ব হয়ে উঠেছে তাদের শৈশব, কৈশোর।
কোলকাতার বিশিষ্ট এক স্কুলের ক্লাস টেন এর ছাত্রী কৃত্তিকা পাল আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে আমাদের সকলকে এক অস্বস্তিকর আতঙ্ক এবং বিরাট প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিল। কতটা হতাশ এবং বেদনার্ত হয়ে এই নিষ্পাপ কিশোরী এমন কাজ করলো? এই ভয়ানক কাজের দায় কি অভিভাবক বা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা এড়াতে পারে?
সন্তানের সাফল্য যেন মা বাবার একমাত্র অভিষ্ট। আর সাফল্যের নিরিখ শুধুই পরীক্ষার নম্বর বা মান। তার নান্দনিক গুণ, মানবিক বিকাশ কোনও কিছুই আর তেমন গুরুত্ব পায়না। তার কী ভালো লাগে, কীসে সে ভয় পায় বা তার অনীহা কোনখানে, এসব মূল্যহীন। তার পড়াশোনা, কোচিং, টিউটর এসবের জন্য অনেক খরচ হয়েছে, তাই নম্বর না পেলে সবই বৃথা। আদর আহ্ণাদ, গল্প বলা বা তার সঙ্গে কিছু ছেলেমানুষি করা, যা তাকে মা বাবার কাছাকাছি আনবে, সেসব নয়, ওগুলো waste of time. তবে status বর্ধনকারী দামি উপহার বা নামী রেস্তোরাঁর খাবার, এসবের ঢালাও ব্যবস্থা। অনেক সময় তা অভিভাবকদের অনুপস্থিতির ক্ষতিপূরণও হয়। অথচ জীবনের সহজ সরল ছোটো খাটো বিষয়ে যে আনন্দের উৎস লুকিয়ে থাকে, তা আজকের এই শহুরে শিশুদের জানাই নেই।
ক্ষুদ্র পরিবারের জটিলতা, মা বাবার কর্মক্ষেত্রের চাপ বা তাদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব- আজকের এই সামাজিক প্রেক্ষাপট শিশুদের নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই কৈশোরে পৌঁছেই তাদের অনেকেই অবসাদগ্ৰস্ত হয়ে পড়ছে। আর এর থেকে বেরোতে শরণাপন্ন হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিকের।
এমনকী অবসাদ কাটাতে নেশা বা আত্মহননের পথ ও বেছে নিচ্ছে। কৃত্তিকা যা করলো।
আজকের শিক্ষা ব্যবস্থার এই ঢালাও নম্বরও অনেকাংশেই দায়ী। কোনও ফলাফল ই যেন যথেষ্ট নয়। আরও আরও ভালো করতে হবে। এটাও ভাবা দরকার।
আর অভিভাবকদেরও ভাবতে হবে, আপনার সন্তান আপনার স্বপ্ন পুরণের যন্ত্র নয়।
এই প্রত্যাশার চাপ থেকে মুক্তি দিন ওদের।
রকিং হর্স উইনার মনে পড়ছে না কি! পড়বে না!
আমিই তো আমার কন্যাকে সেই বাজি জেতা কাঠের ঘোড়ায় তুলেছি, শুধু নম্বরটা জানার জন্য!
দুলে যা, দুলে যা মুখে রক্ত না ওঠা পর্যন্ত!
যদি মুখ দিয়ে না ওঠে, হাতের শিরা কাট, মরে না যাওয়া পর্যন্ত দম বন্ধ করার ব্যবস্থা কর!
ফুল তোকে ফোটাতেই হবে!
আমরা যে পারি নি! আমাদের অনেক দোহাই আছে, কিন্তু তোর দোহাই দেবার মইটাও আমরা সরিয়ে নিয়েছি, উঁচু করে দিয়েছি ঘোড়াটাও, যাতে নামতে না পারিস!
মা, এত উঁচুতে উঠে লাভ কি ? আমি যে পারছি না!
ব্যস্ত, অতি ব্যস্ত, অতি তৃষিত পালক- পিতামাতাও যে জানেন না, জবাবটা কি
Post A Comment:
0 comments so far,add yours