Sucide
কাজল ভট্টাচার্য, কার্টুনিস্ট ও সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতাঃ

এক আকাশ চাওয়া।
চাওয়ার অন্ত নেই।
যতটা আছে তাতে সন্তুষ্ট নই। আরও বেশি চাই। একশোতে একশোই চাই। বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ!
সমাজে যা, তার প্রতিফলন রাজনীতিতেও।
মনের ক্ষুধা যখন সর্বগ্রাসী, অপরাধ হবেই। বিপর্যয় অবধারিত। কোন না কোনও কৃত্তিকা সাড়ে তিন পাতার সুইসাইড নোট লিখতে বসবেই। শিবেরও কি সাধ্য এই কৃত্তিকাদের রোখার?

নিজেরা হয়ত পেরেছি! হয়ত পারিনি! তবে ছেলেমেয়েদের পারতেই হবে। মা বাবার এই বেলাগাম উচ্চাশা পূরণের খেসারত দিতে কৈশোরেই প্রাপ্তবয়স্ক। জীবন তখন উৎসব না। দায়িত্ব পালন। কলুর বলদ। কাঁচা বয়সে যা বিরক্তিকর। এই বিরক্তি মাত্রা ছাড়ালেই বুকের অতলে ক্ষোভের ঢেউ ফুঁসে ওঠা। মুক্তির পথ খোঁজা আরও শত কৃত্তিকার। যাত্রার প্রস্তুতি- মহানির্বাণ যাত্রার। ঘটনার ইঙ্গিত আপাতত সেরকমটাই।

"আমি তোমাদের দেখতে চাই না।"
ঠিক কতটা ঘৃণার বিস্ফোরণ হলে এক কিশোরী এই কথা লিখতে পারে?
মা-বাবার ওপর নেহাতই অভিমান? না, একে অভিমান বলতে রাজি নই।
অভিমান বাড়তে বাড়তেই তা একসময় ঘৃণার রূপ নেয়। ঘৃণার বিজ পোঁতা হয়ে গিয়েছিল সেই মেয়েবেলাতেই। "আমি ছোটবেলাতেই মরতে চেয়েছিলাম।" সেই লাগামছাড়া ঘৃণাই কৃত্তিকাকে ছিনিয়ে নিলো জীবনের কোল থেকে।

অনেক মা, বা বাবার ক্ষোভ দেখেছি, তাঁরা নাকি পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন। পড়তে চাইতেন ইংলিশ মিডিয়ামে। কিন্তু বাড়ির কেউ নাকি তখন পাত্তাই দেয়নি। নিজেদের সেই অতৃপ্ত বাসনা পূরণ হয় ছেলেমেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়ে।
যত মোটা টাকার খরচ তত ভালো স্কুল।
পড়াশোনার যত চাপ, তত ভালো স্কুল। পিঠে বইয়ের মস্ত ব্যাগ। ব্যাগের ভারে মেরুদন্ড দুমড়ে যায় তো যাক। ভালো স্কুলে তো ওরকম হবেই। স্কুলবাসে চড়ে স্কুলে চলেছে কৃত্তিকার দল।

"ওরা আমাকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে," সুইসাইড নোটে লিখেছিল কৃত্তিকা।
পরীক্ষায় একশোয় একশো চাই।
মা বাবা যেন রিং মাস্টার। খাঁচাবন্দি অসহায় উচ্ছল কৈশোর। সময়মতো ভাল খাবার দেব পুষ্টি দেব। জামা দেব কাপড় দেব। প্রতি সাবজেক্টে কমপক্ষে একটা করে টিউশন দেব। শর্ত একটাই, পারফরমেন্সটা একশো পার্সেন্ট চাই। সফলতার উন্মত্ততা।
"আমি তিন মাস ঘুমোতে পারিনি।"
কেন কৃত্তিকা? কী এমন স্বপ্নের পিছনে তাড়া করেছিলে, যা রাতের ঘুম কেড়ে নেয়? ফার্স্ট হওয়াটা এতোই জরুরি? কার স্বপ্নপূরণ করতে গিয়ে 'অকালে মরে' বাঁচতে চাইলে?
"ওরা আমায় আঘাত করবে," লিখেছিল কৃত্তিকা। ওর ভাষায়, "সব ধোঁয়াশা লাগছিল।" 'ওরা' মানে কৃত্তিকার মা-বাবা। আপাতত এমনটাই সন্দেহ পুলিশের।

আসলে এই ক্লাসে 'ফার্স্ট হওয়া ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন' তৈরি আমাদেরই হাতে। কতই বা বয়স হবে এই আধুনিকতার? পঞ্চাশের বেশি না।
এই সেদিনও স্কুল ছিল। স্কুল থেকে ফিরে খেলাধুলা ছিল। বন্ধু ছিল। ভাই ছিল, বোন ছিল। আর ছিল কিছু অপাপবিদ্ধ দুষ্কর্ম। লুকিয়ে চুরিয়ে সিনেমা দেখা। পাশের বাড়ির বাগান থেকে পেয়ারা চুরি করা। ছেলেদের একটু-আধটু পাড়ার টেপি, মেয়েদের খোকাদাকে আড়চোখে দেখা।
স্কুলের বইয়ের পাশাপাশি ছিল শুকতারা, ঠাকুরমার ঝুলি। মা বাবার শাসন সামাল দিতে ছিল দাদু ঠাকুমার মধ্যস্থতা।
দিন ঘুরলো। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। মা-বাবা আর একমাত্র সন্তান। স্কুল থেকে সোজা টিউশন পড়তে ছোটা। বন্ধু ভাইবোনের জায়গা নিল মোবাইল। শুকতারার বদলে সাজেশন বই। দাদু-ঠাকুমারা গেলেন বৃদ্ধাশ্রমে।

প্রতিযোগিতা সর্বস্তরে।
মা বাবারা বইয়ের মুখ দেখেছিলেন পাঁচ বছরে। সন্তানের হাতে বই ধরালেন তিন পেরোতে না পেরোতেই। নামডাক আছে এরকম স্কুলে ভর্তি করতে গেলেই কম্পিটিশন। সেই যে একবার কম্পিটিশনের খাতায় নাম চড়ে গেল তার থেকে আর পালানোর পথ রইলো না অবসরে যাওয়া পর্যন্ত। এরকমই কি কোনও স্মৃতির কথা লিখেছিল বৈষ্ণবঘাটার ছোট্ট কিশোরী?- "সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি ভুলতে পারিনি।"

স্বপ্ন দেখা মানা।
বাস্তবের রোদে তেঁতে ওঠা বালিতে পা ফেলে শুধুই দৌড়নো। মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক হয়ে জয়েন্ট। এ পর্যন্ত মা বাবার হাতে লাগাম। ছন্দপতন ঘটে যায় এরমধ্যেই। বিশেষ করে বয়সটা যখন কাঁচা।
বয়ঃসন্ধির বেলা। যখন দানা বাঁধে স্বপ্নরা। হাতছানি দেয় আকাশে ওড়ার। পূর্ণিমা রাতে ভেজা বালিতে চিত হয়ে শুয়ে তারা গোণার। মন ছোটে। টান পড়ে পায়ের শেকলে। ছটফট করে তোলপাড় হয় মন। মনে জমে ওঠে একরাশ ক্ষোভ। কখনও হতাশা আবার কখনও বা বিদ্রোহী। "তোমরা সবকিছুতে নাক গলিয়ো না," লেখে কৃত্তিকা। তারপরেই লেখে, "ইচ্ছে করে মরে যেতে।"

কৃত্তিকা পাল। কলকাতার রাণিকুঠির জিডি বিড়লা স্কুলের মেধাবী ছাত্রী। আসছে বছর মাধ্যমিক দিত। তবে অন্যান্যদের থেকে একটু আলাদা। কেন? লেখাপড়ায় ভাল, এমন বেশিভাগ ছেলেমেয়েরই প্রথম পছন্দ হয় ডাক্তারি অথবা এঞ্জিনিয়ারিং। কৃত্তিকা ওই দলে পড়তো না। সে  স্বপ্ন দেখতো ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করার। তবু স্বপ্নপূরণ হওয়ার ঢের আগেই নিজেকে নিজে শেষ করে দিলো ওই ঝকঝকে কিশোরী?

কী করছিলো স্কুল? সেখানকার কাউন্সেলিং ব্যবস্থা কি যথাযথ? এমনি হাজারো প্রশ্ন গার্জিয়ান ফোরামের।
এসব প্রশ্ন শুনলেই সেই পাটিগনিতের অঙ্কের কথা মনে পড়ে। একটা নল দিয়ে চৌবাচ্চায় জল ঢোকে। অন্যটায় বেরোয়। চৌবাচ্চা কতক্ষণে জলে ভরবে?
একদিকে মা বাবারা একশোয় একশোর জন্য চাপ বাড়িয়ে যাবেন, আর অন্যদিকে কাউন্সেলিং করে সেই চাপ সামাল দিয়ে যাবে স্কুল। তাহলে স্কুলগুলি শেষ পর্যন্ত মনোরোগ চিকিৎসা কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াবে তো!

"আমি আত্মহত্যা করেছি," লিখে রেখে গেছে কৃত্তিকা। বয়সটা যতই কাঁচা হোক না কেন, মেধায় সে তাঁর মা-বাবার মতো প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে মোটেই পিছিয়ে ছিলো না। ঘটনার পরিণাম কী হবে তা সে ভালভাবেই জানতো। "মৃত্যুর পর আমায় নিয়ে মেডিয়ায় চর্চা হবে। আমার মৃত্যু নিয়ে পুলিশও চর্চা করবে।"
এখানেই শেষ না। সন্দেহবাতিক সমাজের বাঁকাচোখে তাকানোর অভ্যাসটাও জানতো সে। তাই সে নিজেই লিখেছিল, "আত্মহত্যার কথা বিশ্বাস না হলে ভেবো খুন। খুন কিনা কেই বা বলতে আসছে?"

কতই বা বয়স হবে কৃত্তিকার? চোদ্দ কি পনেরো? বাস্তব অভিজ্ঞতা তাকে নির্মম করে তুলেছিল। তারজন্যই সে বুঝতে পেরেছিল, কিছুদিনের মনখারাপ। তারপর দুনিয়া চলবে তার নিজের গতিতেই।
"আমি না থাকলে কোনও ক্ষতি নেই।" মনে হয়েছিল কৃত্তিকার। ব্যক্তি কৃত্তিকা মূল্যহীন। মূল্যবান ওই সাফল্য, যার পেছনে ও সমানে ছুটে চলেছিল। ছুটতে ছুটতে পরিশ্রান্ত কৃত্তিকার কাছে একদিন গোটা দুনিয়াটাই মূল্য হারালো। মৃত্যু হলো তার সুন্দর কিশোরী মনের। শরীর তখনও জীবিত। অথবা বলা যেতে পারে, জীবন্মৃত। আতঙ্ক এতটাই যে কৃত্তিকা  পালাতে চাইলো তার মা-বাবার কাছ থেকেও। "এর আগেও মরতে চেয়েছিল মেয়ে," নিজের মুখেই কৃত্তিকার মা জানিয়েছেন সে কথা।

মুখ-মাথা প্লাস্টিকে ঢেকে। হাতের শিরা কেটে। নিজেকে শেষ করার এই নির্মম পথ বেছে নেওয়ার মধ্যেই স্পষ্ট, কী ভীষণ দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল কৃত্তিকার জীবন। এক যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই সে মুক্তি পেতে চেয়েছিল, অন্য আর এক যন্ত্রণার।
শ্বাসরুদ্ধ হয়েই মারা গেছে কৃত্তিকা। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে এরকমটাই জানানো হয়েছে। জীবন যন্ত্রণার থেকে ওই মরণ যন্ত্রণাই শ্রেয়, মনে হয়েছিল কৃত্তিকার।
তবে মরণের সামনে দাঁড়িয়েও কৃত্তিকা জীবনের হাতছানা অস্বীকার করতে পারেনি।
তবু তদন্ত চলছে। কৃত্তিকার জীবন বিষিয়ে দিলো কে? শুধুই কি মা-বাবা। নাকি নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছিলেন আরও কেউ?

ঘটনা যাই হোক, মৃত্যুবরণ করার আগে অসহায় কিশোরী আমাদের জানিয়ে গেল- "আমি ছোটবেলাতেই মরতে চেয়েছিলাম। তবে এভাবে মরতে চাইনি।"
কৃত্তিকারা মরতে চায় না।
কৃত্তিকারা বাঁচতেই চায়।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours