গৌতম ভট্টাচার্য, সমাজকর্মীঃ
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে একটা সামাজিক বৈষম্য এবং অনাগ্রহ সবসময়ই ছিল, আজও আছে। পঙ্গু শিশুর কোনও ভবিষ্যত নেই, তাই এই ধরনের শিশুরা পরিবারের বোঝা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষের গড়পরতা ধারণা শারীরিক ভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের কোন দিন কোনও উন্নতি সম্ভব নয়। এই ধারণার বাইরে অভিভাবকরাও যে নেই তেমনটাও নয়। শারীরিক ও মানসিক ভাবে পঙ্গু ব্যক্তি সব সময়ের জন্য দয়া ও করুণার পাত্র হয়। অথচ আমরা ভুলে যাই যে পঙ্গু, বিকলাঙ্গ মানুষের করুণার চাইতে বেশি দরকার সামাজিক অধিকার। দয়া নয় দরকার সহমর্মিতার,সমানুভবতার। শিশুর উন্নতির জন্য সব রকম অবস্থাতেই প্রত্যেকটি শিশুর শিক্ষার প্রয়োজন,সেই শিশু যদি প্রতিবন্ধীও হয় তবুও এটা সর্বৈব সত্য। হতে পারে সেই প্রদেয় শিক্ষা শিশুর প্রতিবন্ধকতার প্রকৃতি ভেদে স্বাভাবিক শিক্ষা অথবা তার জন্য নির্দিষ্ট বিশেষ শিক্ষা। কারণ এর দ্বারাই শিশুর সার্বিক বিকাশ সম্ভব।
প্রতিটি প্রতিবন্ধী শিশুর সবিশেষ যত্ন ও দেখাশোনার প্রয়োজন। যদি তারা সঠিক সুযোগ পায় এবং সঠিক সময়ে শুরু করে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত হয় তবে তারাও তাদের জীবনধারণের জন্য নুন্যতম প্রয়োজনীয় কাজ অল্প আয়াসেই করতে পারে। প্রতিবন্ধকতা তখনই জীবনে দুঃখ বয়ে আনে যখন প্রতিবন্ধী শিশুর প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে আমরা ব্যর্থ হই।
বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধী, বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধী,বহুবিধ প্রতিবন্ধী, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, শ্রবণ প্রতিবন্ধী,বাক প্রতিবন্ধী এগুলোই বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। মাত্রা অনুযায়ী প্রতিবন্ধকতাকে মৃদু, মাঝারী, তীব্র, চরম এমত ভাগে ভাগ করা হয়। এই প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে একটিও অসুখ বলে চিহ্নিত নয়। এগুলো আসলে মস্তিষ্কের একটি অবস্থা। প্রতিবন্ধকতা নিয়ে অসুখের ধারনা আমাদের মধ্যেও প্রবলভাবে আছে।
বেশীর ভাগ প্রতিবন্ধকতার কারণ আমাদের অজানা ৷ তবে দীর্ঘ গবেষণালব্দ্ধ কিছু কিছু সম্ভাব্য তথ্যকে প্রতিবন্ধকতার কারন হিসেবে দেখা হয়। যেমন, বংশানুক্রমিক জিনগত ত্রুটি,মায়ের বয়স যদি ১৬ বছরের নিচে অথবা ৩৫ বছরের উপরে হয়। গর্ভাবস্থায় মায়ের পুষ্টির অভাব। গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসের মধ্যে যদি মা কোনরকম কড়া ঔষধ গ্রহণ করে থাকেন অথবা কীটনাশকের বিষক্রিয়া হয়ে থাকে ৷ গর্ভাবস্থায় যদি মায়ের বিশেষ ধরনের হাম হয় ৷ এটি সাধারণত ইন্দ্রিয়স্থানে প্রভাব বিস্তার করে থাকে (শ্রবন এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে), সেরিব্রাল পালসি (জন্মের সময় মাথায় আঘাত অথবা প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাব) অথবা মানসিক প্রতিবন্ধকতা । গর্ভধারণকারী মায়ের যদি হৃদযন্ত্র সংক্রান্ত জটিলতা বা ডায়াবেটিস থাকে৷ গর্ভধারণকারী মায়ের যদি বিভিন্ন অভ্যাস থাকে যেমন- মদ্য পান, ধূমপান , তামাক ব্যবহার করা ইত্যাদি।
ভারতবর্ষে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আইন ১৯৯৫’ বলবৎ হয়। ১৯৯৬ সালের ১ জানুয়ারি ভারত সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তি (সমান সুযোগ, শিক্ষা ও অধিকারের সুরক্ষা এবং সমাজের মূলস্রোতে সম্পূর্ণ অংশগ্রহণ) আইন, ১৯৯৫ পাশ করে। এই আইন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের (PWD বা Persons with disability) অধিকারগুলি সুরক্ষিত রাখে। এই আইনটিই ২০১৬ সালে পরিবর্ধিত,পরিমার্জিত ও সংযোজিত হয়ে THE RIGHTS OF PERSONS WITH DISABILITIES ACT, 2016 (প্রতিবন্ধী ব্যাক্তির অধিকার সংক্রান্ত আইন ২০১৬) হয়।
২০১১ সালের আদমসুমারী অনুযায়ী (২০১৬ তে পরিমার্জিত) ১২১ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ২.৬৮ কোটি মানুষ প্রতিবন্ধকতার শিকার যেটা সমস্ত জনসংখ্যার ২.২১ শতাংশ। মোট প্রতিবন্ধী জনসংখ্যার ৩৫.২৯ শতাংশ শিশু, যার মধ্যে কম বেশী প্রায় ৬ লক্ষ শিশু অটিজম এবং সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত। মোট প্রতিবন্ধী জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ বা দেড় কোটি পুরুষ এবং ৪৪ শতাংশ বা ১.১৮ কোটি মহিলা। এর সিংহভাগই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। ভারতে সব বয়সের প্রায় ৪১ লক্ষ মানুষ দৃষ্টিহীন এবং ৪৭ লক্ষ মানুষ শ্রবণ প্রতিবন্ধী।
২০০১ থেকে ২০১১ এই দশ বছরে ভারতে প্রতিবন্ধী জনসংখ্যা ২২.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামীন এলাকায় প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। শিশু প্রতিবন্ধীর সংখ্যা উত্তরপ্রদেশে সবচেয়ে বেশী। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার।
প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সরকারী সুযোগ সুবিধা নানাভাবে বেড়েছে। সরকারী চাকরীতেও প্রতিবন্ধী মানুষের সংরক্ষন চালু আছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রশিক্ষন দিতে বিশেষ শিক্ষা (special education) B-Ed, M-Ed ও care giving course চালু আছে এবং এই বিষয়ে শিক্ষিত হবার আগ্রহ বাড়ছে। বিদ্যালয়গুলিতে inclusive education চালু হওয়াতে সরকারী স্কুলে এবং বেসরকারী স্কুলে বিশেষ প্রশিক্ষক নিয়োগ এখন বাধ্যতামূলক।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা ভারতবর্ষে সরকারী এবং বেসরকারী উদ্যোগে নানান বিশেষ প্রশিক্ষন কেন্দ্র চালু আছে যেখানে শিশুদের প্রতিবন্ধকতার মান ও প্রকার নির্ধারনের পর বিশেষ প্রশিক্ষন বিশেষ পদ্ধতিতে দেওয়া হয়। এই ধরনের প্রশিক্ষন শিশুদের স্বনির্ভর করে তুলতে এবং যথাসম্ভব সার্বিক বিকাশে সাহায্য করে।
প্রথমেই যে কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল যে,দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। এদের জন্য নির্দিষ্ট সুযোগ সুবিধা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়, প্রাপ্য সুবিধা গ্রহনের নিয়মাবলির আরও সরলীকরণ প্রয়োজন। প্রাপ্য সুবিধা প্রদানে কেউ অস্বীকার করলে তার অভিযোগ জানানোর সুযোগ বৃদ্ধি এবং প্রতিকার পাবার সহজ ব্যবস্থা থাকা জরুরী। সর্বত্র বাধাহীন হাঁটাচলা, ওঠানামার সুবিধা এখনও অপ্রতুল। সরকারী প্রোৎসাহনে আরও বেশী সংখ্যক প্রশিক্ষন কেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন। কর্তব্যরত চালু প্রশিক্ষন কেন্দ্র গুলিও আরও সরকারী সহযোগীতা ও সুযোগ সুবিধা প্রত্যাশা করে। প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সামাজিক ন্যায় ও সচেতনতা বৃদ্ধি হলে এই ধরনের মানুষ ও তার পরিবার জীবন জীবিকায় যেমন সচ্ছন্দ বোধ করবেন তেমনি সহজে সমাজের মূল স্রোতের অংশীদারও হতে পারেন।
প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি যেমন জরুরী তেমনি এই সচেতনতা বৃদ্ধির অন্যতম অন্তরায় অভিভাবকবৃন্দ নিজেরাই। তারা তাদের বিশেষ সন্তানকে মানসিকভাবে তার প্রতিবন্ধকতা সহ যত দ্রুত এবং যত সহজে গ্রহন করতে পারবেন, সন্তানের কারণে দুঃখবিলাশী জীবনকে অস্বীকার করতে পারবেন, সন্তানকে স্বনির্ভর করে তুলতে ও তার সার্বিক বিকাশকে যথাসাধ্য গুরুত্ব দিতে পারবেন এবং সেইকাজে যথেষ্ট সজাগ মনোনিবেশ করতে পারবেন তার স্পষ্ট প্রতিফলন সমাজেও তত দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। বিশেষ প্রশিক্ষন কেন্দ্রগুলিতে যে বিশেষ প্রশিক্ষন দেওয়া হয় তা মূলতঃ অভিভাবকদের জন্য। অভিভাবক নিজে যত তাড়াতাড়ি প্রশিক্ষিত হতে পারবেন এবং সেই প্রশিক্ষনের পদ্ধতি মেনে বাড়িতে অভ্যাস করাতে পারবেন সন্তানের উন্নতি তত চাক্ষুষ করা যাবে।
সুতরাং এই ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতনতা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। অভিভাবকবৃন্দ সচেতন হলে শিশুরা খুব অল্প বয়সেই বিশেষ প্রশিক্ষন কেন্দ্রে এসে পৌঁছাবে।
বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থার যে প্রভূত উন্নতি হয়েছে তার ফলে এখন একটি বিশেষ শিশুর প্রতিবন্ধকতা সম্বন্ধে পরিস্কার চিত্র শিশুর জন্ম পরবর্তীতেই দেওয়া সম্ভব। তবু আমরা যারা এই শিশুদের নিয়ে কাজ করছি তারা তাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, এই ব্যাপারে চিকিৎসকেরা সময়োচিত সচেতন হয়ে যদি প্রতিবন্ধী শিশুর অভিভাবকদের পাশে দাঁড়ান তবে অহেতুক কালক্ষেপ ও অর্থের অপচয় ঘটে না। একজন চিকিৎক তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে যত দ্রুত বিশেষ শিশুর অভিভাবককে মনোচিকিৎসক বা বিশেষ প্রশিক্ষকের কাছে পাঠাবেন,শিশুর পক্ষে ততই মঙ্গল।
আমাদের শিল্প শহর এবং তার সংলগ্ন এলাকায় ক্রমবর্ধমান বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর কথা মাথায় রেখে দুর্গাপুরের দয়ানন্দ রোডে সদ্য গড়ে ওঠা বিশেষ বিশেষ প্রশিক্ষন কেন্দ্রে Durgapur STAR (Durgapur Society for Training And Rehabilitation for Differently Abled People) মাত্র ২ জন শিশুর প্রশিক্ষন দিয়ে শুরু করে আজ ১৭ জন শিশুর প্রশিক্ষনে উল্লেখযোগ্য কাজ করে চলেছে। এই প্রতিষ্ঠান তার জন্ম লগ্ন থেকেই গত তিনবছরে প্রশিক্ষনরত অভিভাবকদের মধ্যে এক ভিন্ন বার্তা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে যে, Durgapur STAR শুধুমাত্র একটি বিশেষ প্রশিক্ষন কেন্দ্র নয় একটি বৃহৎ পরিবারও বটে। যে অভিভাবকেরা তাদের বিশেষ শিশুর কারণে এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত একা একা দিন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তারা আজ শিশুর প্রশিক্ষনে যেমন যত্নশীল তেমনি হাতে হাত ধরে একে অপরের সাথে সুখেদুখে আনন্দে কলকল। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে Durgapur STAR প্রথম থেকেই উদ্যমী। সচেতনতা জাগরনের কাজে এই প্রতিষ্ঠানের অভিভাবকেরাই আজ সর্বাগ্রে এগিয়ে আসছেন। শিল্প শহরে বিশেষ শিশুর অভিভাবকদের মধ্যে এই মানসিকতা তৈরীর কাজ এই প্রথম।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours