সুবীর পাল, এডিটর দ্য অফনিউজ): বিশ্বজুড়ে ২০ লাখের বেশি মাকে প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগে আক্রান্ত করছে। এই রোগটি কী? যোনিপথ, মূত্রাশয় ও মলদ্বারের মাঝখানে কোনো অস্বাভাবিক ছিদ্র তৈরি হলে একে প্রসবজনিত ফিস্টুলা বলে। এটি একটি জটিল রোগ, এবং গুপ্ত রোগ। এই রোগের কারণ হলো, বিলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত প্রসব এবং যথাযথ চিকিৎসা সুবিধা না থাকা। এর ফলে কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই প্রস্রাব-পায়খানা বের হয়ে যায়। বিব্রতকর গন্ধ এবং সার্বক্ষণিক ভেজা-ভাব স্বাভাবিক জীবন-যাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুসারে মাদাগাস্কারে প্রতিবছর প্রায় ২০০০ নারী সন্তান জন্মদানের সময় প্রসব-জনিত ফিস্টুলার শিকার হয়। কারণ তারা সময়মত সিজারিয়ান সি-সেকশন বা অস্ত্রোপচার কিংবা চিকিৎসা সহায়তা পাননা। আর একবার তাদের ফিস্টুলা দেখা দিলে খুব সামান্য শতাংশ নারী তা সমাধানের জন্য সার্জারির সুযোগ পায়।
আফ্রিকার দেশ মাদাগাস্কারের একদল নারী এই সমস্যা মোকাবিলায় তৈরি করেছেন নতুন এক নজির। তারা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে নিজের ও নিজেদের জীবনের কষ্টকর অভিজ্ঞতা আর দুর্ভোগের গল্প ছড়িয়ে দিচ্ছেন অন্য আরও অনেক নারীদের মাঝে যাদের চিকিৎসা প্রয়োজন। তাদেরকে মনে করা হচ্ছে 'পেশেন্ট অ্যাম্বাসেডর'। গতবছর এই প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর থেকে অনেকেরই জীবনরক্ষাকারী অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছে।
দাতব্য সংস্থা ফ্রিডম ফ্রম ফিস্টুলা এইসব নারীদের ভ্রমণের খরচ বহন করছে। দ্য ফ্রিডম ফ্রম ফিস্টুলা ক্লিনিকে ৬টি ওয়ার্ড এবং ৪২টি শয্যা রয়েছে। সেখানে সার্জারির জন্য আসা একজন রোগী যাফেলিয়েনে, যার বয়স ৩৮। সে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এসেছে কিন্তু সে ভীত নয় বলে জানায়।
প্রসবকালীন ফিস্টুলা বিশেষজ্ঞ মিশেল ব্রিন তার অস্ত্রোপচার করবেন। এই অস্ত্রোপচারের জন্য প্রথমে ব্লাডার এবং পরে যোনিপথ এর সার্জারি করা হবে। অস্ত্রোপচারের জন্য ৩০ থেকে ৪০ মিনিট সময় লাগে।
এই দাতব্য সংস্থার পরিচালক এলো ওটোবো বলেন, "নিজ সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে ফেরত যাওয়ার আগে তাদের শারিরীক সুস্থতার পাশাপাশি এইসব নারীদের জন্য প্রচুর মানসিক যত্ন প্রয়োজন । সে কারণে তাদের কাউন্সিলর দিয়ে কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা রয়েছে।" পরিচালক ওটেবো বলেন, "এইসব নারীরা শুধুমাত্র শুভেচ্ছা দূত হিসেবে নয়, তারা যেন প্রকৃত অর্থে নিজ কমিউনিটির মধ্যে নেতৃস্থানীয় হয়ে উঠতে পারে সেজন্য তাদের ক্ষমতায়নের কাজ করা হচ্ছে।" এখানে যে শুধু সুস্থ করার কাজটিতেই গুরুত্ব দেয়া হয় তেমনটি নয়। বরং সুস্থতার পর একেকজন রোগী কি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দিন পার করেছে সে গল্প শেয়ার করার এবং তা নিয়ে কোন ধরনের সংকোচের বদলে গর্ব করার প্রেরণাও দেয়া হয় এই সংস্থাটি থেকে। যেমনটা বলছেন ডিরেক্টর ওটোবো-"অনেক ফিস্টুলা রোগী ১৫, ২০ বছর ধরে এই দুর্ভোগ সহ্য করে আসছে এবং এখন তারা আমাদের ক্লিনিকে আসে আমরা তাদের সমাজে ফিরে গিয়ে নিজেদের গল্পগুলো তুলে ধরতে, এবং গর্বের সাথে কথা বলা শেখাই। এবং সামগ্রিক আরোগ্যলাভের প্রক্রিয়ায় এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।" এখানেই শেষ নয়। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় সর্বশেষ ধাপে একটি বিদায়ী পার্টির মধ্য দিয়ে। নিজেদের অভিজ্ঞার গল্প বলার অনুশীলনের সুযোগ এটি। নতুন পোশাক এবং উজ্জ্বল গোলাপি রং এর লিপস্টিক-এ সজ্জিত এই নারীরা সেদিন আত্মবিশ্বাসী এবং উচ্ছ্বসিত। চলে প্রত্যেকের নিজেদের গল্প বলা এবং বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়া। এমনকি তাদের দেয়া হয় সার্টিফিকেটও। অনেক দেশ সি-সেকশন সার্জারি, মাতৃ-স্বাস্থ্য সেবা এবং প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফদের মাধ্যমে ফিস্টুলা সার্বিকভাবে নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সব জায়গায় সেই পর্যায়ের সেবা না পৌঁছচ্ছে মাদাগাস্কারের এসমস্ত নারীরা অন্তত নিজেরাই একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে সহায়তার হাত বাড়াচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য মানুষকে বোঝানো যে ফিস্টুলা রোগীরাও মানুষ এবং তাদের সমাজ থেকে প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয়।
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours