দেবর্ষি মজুমদার, সিনিয়র জার্নালিস্ট, বীরভূম:
অনুব্রতদের কখন অক্সিজেন যায়, আর কখন যায় না, এটা চিকিৎসক নয়, দল ঠিক করে দেয়। অনস্বীকার্য যে, অনুব্রত মণ্ডল একজন পুলিশ আধিকারিক অর্থাৎ থানার বড়ো বাবুকে অত্যন্ত নিন্দনীয় ভাষায় কথা বলেছেন। কিন্তু এর আগে যে উনি বলেননি, এমনটা তো কাউকে বলতে শুনিনি। আর এটা যদি তার প্রথম অপরাধ হয়, দল তার বিরুদ্ধে চটজলদি ব্যবস্থা নিচ্ছে কেন?
বিরোধীরা বলছে, ক্ষমা চাইলেই হলো? গণমাধ্যম বলছে, অনুব্রত দিদির ভাই, কোনও ব্যবস্থায় নেবে না পুলিশ। ধীরে রাধে ধীরে! সাত মণ তেল ও পুড়বে, রাধাও নাচবে? কেউ ভাবতে পেরেছিলেন, অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে পুলিশ এফআইআর দায়ের করবে? ২০১৪ সালে ৩রা সেপ্টেম্বর বোলপুর থানায় ঢুকে ডিউটি অফিসারকে অনুব্রত অনুগামীদের মারধরের ঘটনা ঘটেনি? পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নিয়েছিল?
একটু ভেবে দেখুন, পুলিশ বলছে কে অনুব্রত ও আইসির ফোনালাপের অডিও ভাইরাল করলো তদন্ত করে দেখবে। কিন্তু ওই দুজনের অডিও ক্লিপস প্রকাশ কে করলো? অনুব্রত? নিশ্চয়ই না। আইসি? এতো কদর্য ভাষায় কথা, নিজের স্ত্রীকে নিয়ে? উচ্চ কর্তারা কী অনুব্রতর ফোন ট্যাপ করে? না, অনুব্রতকে উচিত শিক্ষা দিতে যত অসম্মানজনক হোক এই অডিও ফাঁস? সবটাই অনুমেয়। ছাব্বিশে পুলিশকে আরও কাছে টানতে, রাজনৈতিক বার্তা? স্বর্গের সিঁড়ি ভেঙে চোদ্দো তলায় কী জানা যাবে?
অনুব্রত মনে পড়ে? শিবপুরে বিরোধীদের জমি বিরোধী আন্দোলনে সটান ঘটনাস্থলে গিয়ে ডিএসপি কাশীনাথ মিশ্রকে বলে ছিলেন, 'কটা বাজে? ২ ঘণ্টার মধ্যে সব কিছু খালি না হলে আমি ঢুকে যাব ৷ সব চাড়িয়ে দেব।' পুলিশকে প্রকাশ্যে এই নিদানেও তীব্র বিতর্ক তৈরি হয় ৷ এর পিছনে কোনও নোংরা কথা বার্তা হয়নি মনে করেন?
২০১২ সালে নানুরের ওসিকে হুমকির পর ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর অনুব্রত মণ্ডলকে রাজ্য গ্রামন্নোয়ন পর্ষদের সভাপতি করা হয় ৷ সেই থেকে লালবাতি ব্যবহার করতে শুরু করেন তিনি৷ ২০১৪ লোকসভা, ২০১৬ বিধানসভা, ২০১৯ লোকসভা, ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে অনুব্রত ম্যাজিকে বীরভূমে ভালো ফল করে তৃণমূল । এই নির্বাচনগুলির প্রচারে গিয়ে কখনও গুড়-বাতাসা, নকুলদানা, কখনও পাচনের বাড়ি, কখনও চড়াম-চড়াম, কখনও শুঁটিয়ে লাল করে দেব, কখনও খেলা হবে বলে সংবাদ শিরোনামে থেকেছেন তিনি৷ নির্বাচন এলেই কমিশনের তাঁর নামে জমা পড়ে একাধিক অভিযোগ। যার জেরে অনুব্রতকে ৩ বার নজরবন্দিও করে নির্বাচন কমিশন৷ ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সভা থেকে 'পুলিশের উপর বোম মারুন, আমি বলছি বোম মারতে, বিরোধীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিন '- এ ধরনের কথা বলেছেন অনুব্রত। আর তা নিয়ে তোলপাড় হয় রাজ্য৷ এই মন্তব্যের পরেই ওই রাতে খুন হন নির্দল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বাবা সাগর ঘোষ৷ যে মামলায় পরে অব্যাহতি পেলেও একসময় প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন অনুব্রত মণ্ডল। তখন অনুব্রতকে চার ঘণ্টার মধ্যে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ আসেনি। লাল বাতি অঞ্চলের একটা ধারণা আছে, একবার নথ ভাঙতে পারলেই...
জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক আর যায় করুন, তার একটা কথা মনে পড়ে গেল। অনুব্রত একটু খেয়াল করতে পারতেন- শাসনের মজিদ মাস্টারকে তিনি বলেছিলেন, ‘‘মজিদদের মতো লোককে দিয়ে মানুষ খুন করিয়ে শেষে ছুড়ে ফেলাই সিপিএমের রেওয়াজ!’’ তাহলে কী অনুব্রত জমানার শেষের শুরু? সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় পদত্যাগ করার পর ২০০৩ সাল থেকে জেলা সভাপতি ছিলেন অনুব্রত। এমনকি যখন গরু পাচার ও কয়লা পাচার মামলায় জেলে ছিলেন, তখনও যে কোনও বৈঠকে তার চেয়ার ফাঁকা রাখা হয়। নিজের জেলার বাইরেও অনুব্রত মডেল কাজে লাগাতো দল। অনুব্রতর ছবিও কাজে লেগেছিল ২০২৪ ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে। চলতি বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফেরার পর অনুব্রত বুঝতে পারলেন ময়ুরাক্ষী নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। তার গড় আর নেই। অনুব্রত নিজেই বলছেন, বোলপুর আইসি তাঁর অনুসারীদের এফআইআর নিচ্ছে না। এসব কারণেই তার অনুগামীরা ঘর ফিরতে গেলেই মার খাচ্ছে। মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহাকে দিয়ে আইসিকে বলতে হচ্ছে, আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করুন। এসবের বিরুদ্ধে দল এখনও পর্যন্ত নিশ্চুপ। রাজনীতিতে না বলা কথা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাকিটা ক্লাইম্যাক্স!
(www.theoffnews.com Anubrata Mondal audio clip phone TMC)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours