দেবর্ষি মজুমদার, সিনিয়র জার্নালিস্ট, বীরভূম:
ধর্মনিরেপেক্ষতা? উঁহু! কোনও মহারাজা দেননি। আফ্রিকা থেকে সিপলিফটেড আমাদের জন্য পাঠানো তোফা ধর্মনিরেপেক্ষতা নয়। যুগ যুগ ধরে দেশের মাটি এই ধর্মনিরেপেক্ষতা ধারণ করেছে, পোষণ করেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে যতই ফতোয়া আসুক, অন্তত রাতে যদি সবাই লুকিয়ে চুরিয়েও এই ধর্মনিরেপেক্ষতার জিরাফকে দেখতাম, কেমন হতো?
পদাতিক কবির কাব্য নিয়ে বোধহয় আমাদের জীবন চলে না। জীবন চলে অন্য খাতে। তাই আমরা ধর্মেও নেই, জিরাফেও নেই।
য ধৃতি স ধর্ম। আজকে ধর্ম ধারণ করে সাম্রাজ্যবাদ। হয় তুমি আমার ধর্মের, না হলে তুমি বিধর্মী, আমার শত্রু। প্রতিটি সম্প্রদায়ের ধর্মাচারীদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দর সেই "ইউনিভার্সাল একসেপ্ট্যান্স, টলারেন্স" চেতনা বোধ অদৃশ্য। কারও বেশি, কারও কম, বা কারও সেটা আছে, এই টুকুই তফাৎ বা মিল। অন্যকে অস্বীকার করার এতো তীব্রতা, মনুষ্য মাত্রই সম্ভব। যাক, এগুলো আমরা সবাই জানি।
আমার যেটা জানি, কিন্তু বুঝি না বা বুঝি কিন্তু জানতে চাই না কিম্বা বুঝতে চাই না- সেটা বলা যাক।
যে কোনও সম্প্রদায়ের মধ্যে একদল আছে তুলনামূলক কম বা বেশি বা আদৌ নেই, তারা ভাঙচুর, লুঠপাট ও খুন জখমে বিশ্বাসী। তারা নিজেদের মধ্যে বা অন্যের মধ্যে সেগুলোতে সরাসরি অংশগ্রহণ করে বীরত্ব প্রকাশ করে। আরেকদল আছে, তারা দূরে থেকে কুযুক্তি বা অযৌক্তিক যুক্তি দেখিয়ে সেই অপরাধ গুলোকে আড়াল করার চেষ্টা করে। সেটা কিভাবে করে?
১) ভিকটিম কার্ড। ২) বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ তুলে। ৩) সম্প্রদায় আইডেন্টিটি ঢেকে বলে, ধর্ম বলবেন না, বলুন মানুষ করেছে। ৪) ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে। ৫) অন্য রাজ্যের, অন্য দেশের সুদূর অতীতের কোনও ঘটনা উদ্ধৃত করে সাম্প্রতিক অন্যায়কে জাস্টিফাই করে। ৬) সবই গুজব মিথ্যা বলে ধামাচাপা দিয়ে। ৭) বিভিন্ন ন্যারেটিভ তৈরি করে। সেটা তাদের সম্প্রদায় কতো ভালো তার দূর দূর ঘটনা দেখিয়ে। বা ফলস ন্যারেটিভ বানিয়ে অপপ্রচার করে। একটা ভালো ঘটনা দেখিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভে কোনও লাভ হলে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু যখন যে রোগ তার উপসর্গ অবজ্ঞা করে, কোনসময় তার শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল বা অন্য কোথাও কোনও ব্যক্তি সুস্থ আছে সেই আলোচনায় রোগাক্রান্ত ব্যক্তির রোগ নিরাময় হতে পারে না। অর্থাৎ যে রোগ ধরা পড়েছে, সেটা রোগ। তার নিরাময়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ধর্মকে ভিত্তি করে কোনও সম্প্রদায় একজোট হলে, স্বাধিকার। আর অন্য কোনও সম্প্রদায় একজোট হলে সাম্প্রদায়িক, এটা বেশি দিন চলতে দিয়ে দেখুন, আখেরে কী লাভ হয়? ৮) সম্প্রদায় ভিত্তিক ন্যারেটিভে সফট টার্গেট কারা? উত্তর একটাই। যারা ঐক্য বদ্ধ নয়। এখন প্রশ্ন, ঐক্যবদ্ধ না হতে দেওয়া কাদের কৌশল?
ক) ধর্মভিত্তিক রাজনীতি:-১) একটি ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল যারা হিন্দুধর্ম, তার রীতিনীতির সমালোচক। সেক্ষেত্রে ধর্ম "আফিম" মতের তারা প্রবর্তক। তারা হিন্দু ধর্মে কুসংস্কার খোঁজে। আবার ইসলাম, খ্রীষ্টান সহ অন্যান্য ধর্মে তাদের অবাধ প্রেম। ২) অন্য আরেকটি ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল দেখায় তারা হিন্দু ধর্ম প্রেমী। তবে সেটা সেই রাজনৈতিক দল দ্বারা স্বীকৃত বা পালিত হতে হবে। বাদবাকি সাম্প্রদায়িক ও দাঙ্গাবাজ। সেই দল রাম নবমীতে মুসলিমদের দিয়ে হিন্দুদের পানীয় খাওয়াবে। ফটো শেসন হবে। ক্যাপশন থাকবে- "ভালো মুসলিম হিন্দুদের ঘৃণা করে না। ভালো হিন্দু মুসলিমদের ঘৃণা করে না।" অর্থাৎ যেটুকু হয় ব্যতিক্রম। না হলে আরও বেশি হতো। থাকতে পারতো না। ইত্যাদি। কেউ বলবে, শিক্ষা নেই, বেকারত্ব তাই এসব হচ্ছে। অর্থাৎ বেকারত্বের জন্য হিন্দুরাই দায়ী? হিন্দু দেবদেবী দায়ী? তাহলে বেকারত্বের কথা আসছে কেন? স্বজাতি ও স্বধর্মের প্রতি এই ধার্তরাষ্ট প্রেম যত দেখা যাবে, তত প্রশস্ত হবে ধর্মের বিস্তৃতি। ৩) আরেক আপাত নির্দল দেখাবে তারা অরাজনৈতিক। তারা বলবেন, একসাথে বড়ো হলাম, কোনও দিন হিন্দু বা মুসলিম কি জানলাম না। এখন জানছি। হিন্দু মুসলিম করবেন না। বলুন মানুষ। বাংলাদেশ থেকে যে হিন্দুরা সব কিছু ছেড়ে প্রাণ টুকু নিয়ে আসতে পেরেছিল, তাদের দুই একজনকে বলতে শুনেছি, "পরিচিতরা রাতে চুরি করতে এসেছে। বাড়ির সবাইকে সাবধান করে বলেছি, "মানুষ" এসেছে রে। সাবধানে থাকিস। সাহস করে চোর বলতে পারিনি। তাহলে দল বেঁধে এসে চোর বলার অপরাধে সব লুঠ করে নিয়ে যাবে।" এদেরই কেউ রাজনৈতিক মতাদর্শের জিকিরে আজ ইলিশের সইতুতো সম্পর্কে বলবে, "সব মানুষ সমান না। আমি ধর্ম মানি না।" নিজের টাকে মানি না বলা সহজ। অন্যেরটাকে সমীহ না করলে কল্লা যাবে যে। ৪) আরেক আপাত উদারনৈতিক বলবে, আমি নামায পড়ি না। সব হিন্দুদের অনুষ্ঠানে যায়। তারা কিন্তু অনেকটা এক রাজনৈতিক দলের মতো। সারা বছর নিন্দা করবে। কিন্তু আইন পাশের সময় ভোটাভুটিতে জয়েন না করে, তাদেরই পাশ করিয়ে দেবে। কিছু ভালো মানুষ দেখবে এই উগ্র লোক আমাদের সম্প্রদায়ের তো ক্ষতি করছে না। যাগগে এসব ভেবে লাভ নেই। তারপর? যেখানে হিন্দু নেই! তারা খুব সুখে আছে তো? সুখে থাকতে পারলেই ভালো। ৫) আরেক দল আছে যাদের বদনাম, হিন্দুত্বের ঠিকাদার বলে। যখন পুলিশ কিছুই করতে পারলো না। রতনপুরে মা শীতলার মূর্তি ভাঙলো, বাড়ি ঘর পুড়লো, দোকান লুঠ হলো, হিন্দুদের ঘর ছেড়ে পালাতে হলো, দুই মৃর্তির কারিগর হরগোবিন্দ দাস ও চন্দন দাসকে কুপিয়ে খুন করা হলো, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের হিরন্ময় নীরবতার মধ্যে, তখন সেই ধর্মের ঠিকাদার দলের কয়েকজন আদালতে গিয়ে সেন্ট্রাল ফোর্স ডিপ্লয়মেন্ট অর্ডার নিয়ে এলো। না হলে হয়তো এই ওয়াকফ কাণ্ডে আরও হিন্দুদের বেঘোরে প্রাণ যেত। বলুন তো
ওয়াকফ বিলের সঙ্গে দূর দূর পর্যন্ত এই অনভিপ্রেত ঘটনার কোনও সম্পর্ক আছে? যদি কোনও "জিরাফ" আমাকে এর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক দেখাতে পারে, আমি তাকে সালাম জানাবো। বিশ্বাস করতে হবে বেকারত্বর জ্বালায় এসব করতে হয়েছে? ভাতের জন্য এসব করেছে? কই টার্গেট তো ভুল হয়নি। টার্গেট ভুল হয়নি পাকিস্তান আদায়ে, কাশ্মীর দখলে টার্গেট ভুল হয়নি। বাংলাদেশে যেমন টার্গেট ভুল হয় না। ভবিষ্যতে প্যালেস্টাইনে ইজরাইল আক্রমণ করলে এখানে হিন্দুদের ভুগতে হবে না, এমন আশঙ্কা অনেকের দূরাশা হলেই মঙ্গল। ছেচল্লিশে দাঙ্গার সময় বলা হয়েছিল, এখানকার বাঙালি মুসলিমের দোষ ছিল না, পশ্চিমা মুসলিমরা উস্কে ছিল। উস্কালে, নিজের ঘরে তো কেউ আগুন দেবে না। ওয়াকফ তো বাহানা হয়ে গেল। ছেচল্লিশে একই বৃন্তের দুটো কুসুমের বিনা প্ররোচনায় দাঙ্গা আগেও অনেকে দেখেছে। ইংরেজি ২৫ সালে আমরা দেখলাম।
(www.theoffnews.com riots)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours