সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:

(তানজানিয়ার লোককথা)

একসময়ে বাঁদর কী’মা আর হাঙর পা’পা-র মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল।

কী’মা থাকত সাগর কিনারে একটা বিশাল কুয়ু গাছে, যার আদ্ধেক ডাল ছিল জলের ওপরে আর আদ্ধেক ছিল ডাঙার ওপরে।

প্রত্যেকদিন সকালে কী’মা বাঁদর যখন কুয়ু গাছের বীজ দিয়ে প্রাতরাশ সারত, পা’পা হাঙর ঠিক সেই সময়ে হাজির হতো কুয়ু গাছের নিচে আর গলা তুলে বলত - “আমাকেও কয়েকটা বাদাম ছুঁড়ে দাও বন্ধু,” আর কী’মাও খুশি মনে তার ডাকে সাড়া দিত। 

এরকম করেই বেশ কয়েক মাস চলার পর একদিন পা’পা বলল - “কী’মা, তুমি আমার কী উপকারটাই না করেছ! আমি চাই তুমি আমার সঙ্গে আমার বাড়ি চলো যাতে তোমার ঋণ খানিকটা অন্তত শোধ করতে পারি।”

“সেটা কী করে সম্ভব?” কী’মা বলল; “আমরা ডাঙার প্রাণীরা তো জলের ভেতরে যেতে পারি না!”

“ওসব নিয়ে ভেবোই না,” হাঙর তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “আমি তোমাকে আমার পিঠে চাপিয়ে নিয়ে যাব। একফোঁটা জল তোমার গায়ে লাগবে না।”

কী’মা খুব খুশি হয়ে বলল - “তাহলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল; চলো, যাওয়া যাক।”

অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর হাঙর সাঁতরানো বন্ধ করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল আর তার বন্ধুকে বলল - “তুমি আমার বন্ধু। তোমাকে সত্যি কথাটা বলতেই হবে।”

বাঁদর খুব অবাক হয়ে গিয়ে শুধোল - “যাঃ বাবা! তোমার আবার কী বলার আছে?”

“আসলে হয়েছে কী, বুঝেছ ভায়া, আমাদের রাজা খুব অসুস্থ, আর রাজবৈদ্য আমাদের বলেছেন একমাত্র যে জিনিষটি তাঁকে বাঁচাতে পারে সেটি হচ্ছে একটি বাঁদরের কলজে।”

কী’মা জোরে বলে উঠল - “তুমি তো আচ্ছা গাড়ল হে! রওয়ানা হবার আগে এই কথাটা একবার বলতে পারলে না!”

পা’পা বলল - “কেন বলত?”

কিন্তু বাঁদর তখন মরীয়া হয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাবার উপায় ভাবছিল, তাই পা’পার কথার কোনও উত্তর দিল না।

হাঙর খুব উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল - “কী হল ভাই? কিছু বলছো না কেন?”

“আঃ! এখন আর বেকার বকেই বা কী লাভ? যা হবার তা তো হয়ে গেল। কিন্তু তুমি যদি এই ব্যাপারটা আমাদের আসার আগে বলতে তাহলে আমি নিশ্চিত করে আমার কলজেটা আমার সঙ্গে নিয়ে আসতাম।”

“সেকি? তোমার কাছে তোমার কলজেটা নেই?

“ওহ! তুমি কি আমাদের সম্বন্ধে কিছুই জানো না?” চীৎকার করে বলে উঠল কী’মা। “যখন আমরা বাইরে কোথাও যাই আমাদের কলজেটাকে গাছে ঝুলিয়ে রেখে আসি আর শুধু শরীরটা নিয়ে বেরিয়ে আসি। কিন্তু আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি তুমি আমার কথা একেবারেই বিশ্বাস করছো না। তুমি ভাবছ আমি ভয়ে ভুল বকছি। ছাড়ো ওসব কথা; চলো, তোমার বাড়ি যাওয়া যাক, ওখানে গিয়ে আমাকে মেরে বৃথাই আমার কলজেটা খুঁজে মরবে।”

হাঙরটা কিন্তু তার কথা বিশ্বাস করে ফেলল আর জোরের সঙ্গে বলল - “আরে, না, না, চলো ফিরে গিয়ে তোমার কলজেটা নিয়ে আসা যাক।”

কী’মা সটান অস্বীকার করে বলল - “আদপেই না। চলো তোমার বাড়ি যাওয়া যাক।”

কিন্তু হাঙর বাঁদরের কোনও কথাই শুনবে না, সে শুধু জোর করতে লাগল যে তাদের এখনই ফিরে যেতে হবে, কলিজাটা নিতে হবে, তারপর আবার যাত্রা শুরু করতে হবে।

এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ তর্কাতর্কি হবার পর কী’মা বাঁদর লোক দেখান প্রচণ্ড অনিচ্ছা সহকারে রাজি হলো, যদিও ফিরতি পথে সারা রাস্তাটা সে তার এই অযথা হয়রানির জন্য গোমড়ামুখে বিড়বিড় করতে লাগল।

গাছটায় তারা যখন পৌঁছাল, কী’মা হড়বড় করে গাছে ওঠার সময় বলতে বলতে গেল - “স্যাঙ্গাত, একটু অপেক্ষা করো, আমার কলজেটা নিয়ে আসি, তারপরে আমরা আবার ঠিকঠাক করে রওনা দেব।”

যখন সে গাছের অনেক ওপরে উঠে গেল তখন ডালপালার মধ্যে সে নিজেকে লুকিয়ে চুপটি করে বসে রইল। 

যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়েছে মনে করে হাঙর এবার ডাকাডাকি শুরু করল - “আরে কী’মা, চলে এসো, কী করছ এখনও? অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে!” কিন্তু কী’মা টুঁ শব্দটি না করে স্থির হয়ে বসে রইল।

খানিকক্ষণ পরেই পা’পা আবার হাঁক দিল - “ওহ্‌, কীমা! এবার আমাদের যেতেই হবে।”

এবারে বাঁদর মগডালের পাতার থেকে মুখ বের করে খুব অবাক সুরে বলল - “যেতে হবে? কোথায়?”

“আরে, এর মধ্যেই ভুলে গেলে, অবশ্যই আমার বাড়িতে।”

কী’মা শুধলো - “তুমি কি পাগল হলে?”

“পাগল? মানে, কী বলতে চাইছো তুমি?” পা’পা চেঁচিয়ে উঠল।

“তোমার কী হয়েছে বলত? বাঁদর বলল। “তুমি কি আমাকে ধোপার গাধা পেয়েছ?”

“ধোপার গাধার আবার কী বিশেষত্ব আছে?”

“তার কলজেও নেই, আবার কানও নেই।”

হাঙরের তাড়া থাকলেও কৌতূহল বাধা মানল না, তাই সে বাঁদরকে অনুনয় করতে লাগল ধোপার গাধার গল্পটা বলার জন্য। অবশেষে বাঁদর তাকে এই গল্পটা বলল -

“একজন ধোপার একটা গাধী ছিল যাকে সে ভীষণ ভালবাসত। তা সত্ত্বেও সেটা একদিন পালিয়ে গেল আর সোজা বনে পৌঁছে সেখানে আরামের জীবন কাটাতে লাগল আর ক্রমশ বিশাল মোটা হয়ে গেল।

“কিছুদিন পরে ঘটনাচক্রে খরগোশ সুঙ্গু’রা ওই পাশ দিয়ে পেরতে গিয়ে পুন’ডা গাধীকে দেখতে পেয়ে গেল।

“তুমি তো জানো, খরগোশ হচ্ছে প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে ধূর্ত - তুমি যদি ওর মুখের দিকে তাকাও তাহলে দেখতে পাবে ও সবসময় কিছু না কিছু নিয়ে নিজের সঙ্গেই কথা বলে চলেছে। 

“তাই সুঙ্গু’রা যখন পুন’ডা গাধাকে দেখতে পেল সে নিজের মনেই বলল - ‘ওরে বাবা, কী মোটা গাধীটা!’ তারপরে সে এই কথাটি টুক করে সিম’বা সিংহের কানে তুলে দিল।

“আর সিম’বাও তখনি একটা গুরুতর অসুখ থেকে সেরে উঠেছিল বটে, কিন্তু সে হাড়েমজ্জায় এত দুবলা হয়ে গিয়েছিল যে তার এখনও শিকারে যাওয়ার ক্ষমতা হয়নি। তারফলে সবসময় খিদেতে তার নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যাচ্ছিল।   

“সুঙ্গু’রা বলল - ‘কালকেই আমি দুজনের জন্য এতো মাংসের ব্যবস্থা করবো যে আমাদের দুজনারই ভুঁড়িভোজ হয়ে যাবে, কিন্তু রাজামশাই, আপনাকেই শিকারকে বধ করতে হবে।”

“সিম’বা খুব খুশি হয়ে বলল - ‘কুছ পরোয়া নেহি, বন্ধু; তুমি খুব দয়ালু’।

“ব্যাস, খরগোশ গিড়বিড় করে দৌড়ল জঙ্গলে, খুঁজে বার করল গাধীকে, তারপর তাকে তার সবথেকে কেতাদুরস্ত কায়দায় আর্জি পেশ করল - ‘মিস পুন’ডা, আপনাকে বিয়ের প্রস্তাবে রাজী করানোর জন্য আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে’। 

“গাধী লাজুক হেসে বলল - ‘কার কাছ থেকে?’

“খরগোশ বলল - ‘সিম’বা সিংহের কাছ থেকে’।

“গাধী তো আহ্লাদে আটখানা হয়ে আর উত্তেজনায় প্রায় চেঁচিয়েই বলে উঠল - ‘আরে, এক্ষুণি চলো। এর থেকে ভাল প্রস্তাব আর হতে পারে না’।

“তারা শীঘ্রই সিংহের গুহায় পৌঁছে গেল, সাদরে অন্দরে প্রবেশের জন্য আমন্ত্রিত হলো এবং ভেতরে গিয়ে বসল। “সুঙ্গু’রা সিম’বাকে চোখে চোখে ইশারা করলো যে এটাই হচ্ছে সেই প্রতিশ্রুত মহাভোজ আর সে বাইরে অপেক্ষা করছে। তারপর সে পুন’ডাকে বলল - ‘আমার একটা জরুরী কাজের জন্য তোমাকে কিছুক্ষণের জন্য ছেড়ে যেতে হচ্ছে। তুমি এখানেই থাকো আর তোমার ভাবী স্বামীর সঙ্গে গল্পসল্প করতে থাকো।'

“যেই না সুঙ্গু’রা বাইরে পা রেখেছে, সিংহ নিমেষে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুন’ডার ওপরে আর তারপর দুজনে তুমুল লড়াই হলো। সিম’বা তো পুন’ডার দমবন্ধ করা একটা লাথ খেল আর তার দুর্বল শরীরে যতটা জোরে সম্ভব তার নখ দিয়ে পুন’ডার পিঠে আঁচড় বসিয়ে দিল। শেষমেশ গাধী এক ধাক্কায় সিংহকে মাটিতে ফেলে দিয়ে একছুটে গুহা থেকে পালিয়ে গিয়ে বনের ভেতর তার ডেরায় পৌঁছে দম নিল। 

“একটু পরেই খরগোশ ফিরে এলো আর সিংহকে বলল - ‘ওহে সিম’বা! মালটাকে সাপটেছো তো?’  

“সিংহ গরগর করে বলল - ‘না, পারিনি; সে আমাকে লাথি মেরে পালিয়ে গেছে; তবে আমিও তোমাকে দিব্যি কেটে বলছি আমিও ওকে ভাল মতো দিয়েছি যদিও আমি এখনও খুব দুর্বল।’ 

“সুঙ্গু’রা বলল - ‘আরে সব ঠিক আছে, অতো চাপ নিও না, কিন্তু ওকে ভুলেও যেও না।’

“এরপর সুঙ্গু’রা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করলো, যতদিন না সিংহ আর গাধী দুজনেই সুস্থ-সবল হাট্টাকাট্টা হয়ে ওঠে। তারপরে সে বলল - ‘এবার কী মনে হচ্ছে, সিম’বা? তোমার সেই খাবার এবার নিয়ে আসব?’ 

“সিংহ খুব হিংস্রভাবে গর্জন করে বলল - ‘হ্যাঁ, ওটাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি ওকে দু’টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব।’

 “অতএব খরগোশ আবার জঙ্গলে গেল, সেখানে গাধী তাকে স্বাগত জানাল আর কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করতে থাকল।

“সুঙ্গু’রা বলল - ‘তোমার প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করার আবার নেমন্তন্ন এসেছে।’

“পুন’ডা কেঁদে ফেলে বলল - ‘ওহ! ভাইরে, সেদিন সেই যে তুমি আমাকে ওর কাছে নিয়ে গেলে, বাপরে, কী জোরে আমাকে আঁচড়ে দিল। আমার এখন ভীষণ ভয় করছে ওর কাছে যেতে।’ 

 “সুঙ্গু’রা চুটকি মেরে বলে উঠল - ‘আরে, ধুস! ওটা কিস্যু না। সিম’বার আদর করার ধরণটাই অমন।’

“গাধী বলল - ‘আছা, ঠিক আছে, চলো তাহলে।’

“অতএব তারা আবার রওনা হল; এবারে কিন্তু সিংহ যেই পুন’ডাকে দেখতে পেল চোখের নিমেষে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে দু’টুকরো করে ফেড়ে দিল। 

“খরগোশ যখন হাজির হল, সিম’বা তাকে হেঁকে বলল - ‘মাংসটা নিয়ে গিয়ে কাবাব বানিয়ে ফেলো। আমি শুধু কলজেটা আর কান দু’টো খাবো।’ 

“সুঙ্গু’রা বলল - ‘ধন্যবাদ। তারপর সে ওখান থেকে বেরিয়ে গেল আর একটা গোপন জায়গায় মাংসর কাবাব বানাতে লাগল যাতে সিংহ তাকে দেখতে না পায়, আর সে কলিজা আর কান দু’টো লুকিয়ে রাখলো। তারপরে পেটভরে মাংস খেয়ে বাকীটা সরিয়ে রাখল।

“এবার সিংহ তো সেখানে হাজির হলো আর হুকুম করলো - ‘কলজে আর কান দু’টো দাও আমাকে।'

 “সুঙ্গু’রা বলল - ‘কোথায় সেগুলো?’

“সিম’বা হুঙ্কার ছেড়ে বললো - “তার মানে? কী বলতে চাও তুমি?’

খরগোশ বলল - ‘কেন, তুমি জানতে না এটা একটা ধোপার গাধা?’

“সিম’বা অবাক হয়ে বললো - ‘বেশ, তাই-ই বা হলো, তার সঙ্গে কলজে আর কান না থাকার কী সম্পর্ক?’

সুঙ্গু’রা বললো - ‘ভগবানের দোহাই, সিম’বা, তোমার ঘটে কি এতটুকু বুদ্ধি নেই যে এই জন্তুটার যদি কলজে আর কান থাকত তাহলে সে আর দ্বিতীয়বার ফিরে আসত?’

“সিম’বা সিংহকে বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হলো যে সুঙ্গু’রা খরগোশ যা বলছে তা একদম সঠিক। 

কী’মা বাঁদর পা’পা হাঙ্গরকে বলল - “এবার বুঝলে তো, তুমি আমাকে একটা ধোপার গাধা বানাতে চেয়েছিলে। ওইসব মতলব ছাড়ো আর একাই বাড়ি ফিরে যাও। আমার নাগাল তুমি আর কোনদিনই পাবে না, আর আমাদের মিতালিরও এইখানেই ইতি। গুড বাই, পা’পা।”

(www.theoffnews.com Tanzania folk tales)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours