সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:

এতদিন ধারণা ছিল যে প্রাগৈতিহাসিক মানুষরা প্রায় ৪০,০০০ বছর আগে প্রাচীন গুহার দেওয়াল বা ছাদে তাদের অভিজ্ঞতা আঁকার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিল। কিন্তু সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অতি সম্প্রতি প্রত্নবিদরা একটি সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপের মারোস-পাংকেপ অঞ্চলের লেয়াং কারামপুয়াং-এর চুনাপাথর গুহায় আবিষ্কৃত একটি বুনো শুয়োরের সঙ্গে তিনটি মানুষের মিথস্ক্রিয়ার ছবির প্রাচীনত্ব কমপক্ষে ৫১,২০০ বছর বলে নির্ধারণ করেছেন। লাল রঞ্জক দিয়ে আঁকা গুহাচিত্রটিতে একটি শুয়োরের মুখ খানিকটা খোলা এবং তিনটি আধা মানুষ, আধা-প্রাণীর লাঠি মূর্তি বা থেরিয়ানথ্রোপ দেখা যাচ্ছে। ২০১৭ সালে এই গুহায় প্রত্নবস্তুগুলি সংগ্রহ করা হলেও এই বছরের শুরুর মাসগুলিতেও এগুলির বয়েস নির্ধারিত হয়নি। ২০২০ সালে ইন্দোনেশিয়ার লেয়াং টেডঙ্গেতে আবিষ্কৃত যে বুনো শুয়োরের ছবিটি এতদিন সবচেয়ে প্রাচীন বলে মনে করা হতো, এটি তার থেকে ৫০০০ বছরেরও বেশি আগের।

'৫১,২০০ বছর আগে ইন্দোনেশিয়ায় ন্যারেটিভ কেভ আর্ট' নামের এই গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি, সাদার্ন ক্রস ইউনিভার্সিটি এবং ইন্দোনেশিয়ান ন্যাশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন এজেন্সির ২৩ জন গবেষকের একটি দল এটি সম্পন্ন করেছে।

‘দ্য কনভারসেশন’ পত্রিকায় এই গবেষকরা লিখেছেন - “একটি অর্ধেক মানুষের অবয়ব একটি শুয়োরের গলার কাছে একটি হাতিয়ার ধরে আছে বলে মনে হচ্ছে। আরেকজন শুয়োরের মাথার ঠিক ওপরে উল্টো হয়ে পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছবির তৃতীয় জন অন্যদের তুলনায় চেহারায় অনেক বড় আর হাবভাব রাজকীয় এবং সম্ভবত মাথায় জমকালো একটা উষ্ণীষ রয়েছে … যেভাবে এই মানুষের মতো আকৃতিগুলি শুয়োরের চারপাশে আঁকা হয়েছে তাতে একটা গতিশীল কর্মকান্ডের আভাস পাওয়া যায়। এই ছবিটিতে কিছু একটা ঘটছে - একটা গল্প বলা হচ্ছে। আমাদের আবিষ্কারগুলি থেকে ধারণা করা যায় যে আধুনিক মানুষের অ্যানথ্রোমরফিক বা মানুষরূপী প্রাণী এবং প্রাণীদের রূপক ছবি আঁকার ইতিহাস যতটা প্রাচীন বলে মনে করা হতো এই অ্যাকশনধর্মী ছবিটি প্রমাণ করছে যে সে ইতিহাস আরও অনেক পুরনো।”

প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে দেখা যায় যে নিয়ান্ডারথালরা (যাদেরকে আধুনিক মানুষের সবচেয়ে কাছের প্রাচীন মানব আত্মীয় হিসেবে দেখা হয়) ৭৫,০০০ বছর আগে গুহাতে আঁকিবুকি কাটা শুরু করেছিল, কিন্তু এই চিহ্নগুলি সাধারণত বিমূর্ত ছিল, কোন পশু বা মানুষকে আঁকা হয়নি। গবেষকরা আরও বলেছেন - “আমরা আঁকাগুলোর যে ডেটিং-এর কাজ করলাম তার ভিত্তিতে এখন মনে হচ্ছে যে মানুষের ছবিগুলোর (থেরিয়নথ্রোপ বা না-মানুষ প্রাণী সমেত) প্রাণীদের সাথে মিথস্ক্রিয়া করার ছবিগুলি সুলাওয়েসির লেট প্লেইস্টোসিন গুহা শিল্পে এতো বেশি সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে যা পরের কয়েক হাজার বছরে ইউরোপের অন্য কোথাও দেখা যায়নি। এর থেকে বোঝা যায় যে এই অঞ্চলে হোমো স্যাপিয়েন্সের লম্বা ইতিহাসের প্রথম দিকেই গল্প বলার একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল - বিশেষ করে, মানব-প্রাণী সম্পর্কের সম্পর্কে চাক্ষুষ গল্প বলার জন্য নাটকীয় উপস্থাপনার ব্যবহার।"

অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসের অধ্যাপক নয়নজোত লাহিড়ী বলেছেন, "এটা একটা বলবার মত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।"

নতুন ডেটিং-এর কৌশল কি?

চুনাপাথরের গুহায় গুহাচিত্রগুলির ওপর যে ক্যালসাইট জমা হয়েছে তার ইউরেনিয়াম সিরিজ (ইউ-সিরিজ) বিশ্লেষণ করে এই ছবিগুলির কালনির্ধারণ করা হয়েছে। গবেষণার সময় লেজার রশ্মি ব্যবহার করা হয়েছিল এবং প্যারেন্ট আইসোটোপ (ইউরেনিয়াম) এবং ডটার আইসোটোপ (থোরিয়াম)-এর মধ্যে অনুপাত তুলনা করে গবেষকরা ছবিগুলির তারিখ নির্ধারণ করতে সফল হন।

একই পদ্ধতি ব্যবহার করে, গবেষকরা লিয়াং বুলু' সিপং ৪-এ একটি গুহা চিত্রে আরেকটি শিকারের ছবিরও ডেটিং করেছেন, যা আগে ৪৩,৯০০ বছরের পুরনো বলে মনে করা হয়েছিল। তাঁদের পরীক্ষার ফলাফলে জানা গেছে যে ছবিটি আগে যা ভাবা হয়েছিল তার থেকে কম করে ৪,০০০ বছরের বেশি পুরনো।

গবেষকরা বলেছেন - "এই পদ্ধতিটি আমাদের ডেটিং-এর জন্য ব্যবহৃত ক্যালসিয়াম কার্বনেট উপাদান এবং রক আর্ট পিগমেন্ট স্তরগুলির ক্যালসিয়াম কার্বনেট উপাদানের মধ্যে স্পষ্ট সম্পর্ককে আরও সহজে দেখাতে পারে।"

অধ্যাপক লাহিড়ী বলেছেন যে ভারতে সোজাসুজি ডেটিং করা গুহাচিত্রের সংখ্যা খুবই কম। "ভারতে, মধ্যপ্রদেশের মতো জায়গায় প্রচুর রক আর্ট আছে, কিন্তু এগুলির এই ধরনের ডেটিং করা হয়নি।" তিনি যোগ করেছেন, "এই আবিষ্কারটি প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাজের সাথে জড়িত হওয়া বিজ্ঞানের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝায়। আমরা যে এতো আগের সময়কাল পেয়েছি যে আমাদের চিন্তা করতে হবে যে সেই সময়ে কীভাবে এটির কল্পনা করা হয়েছিল এবং আরও অনেক কিছু।”

অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ম্যাক্সিম আউবার্ট বলেছেন, “এই আবিষ্কার মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে ধারণা পাল্টে দেবে। ছবিটির থেকে একটা জটিল গল্পের আভাস পাওয়া যায়। মানুষের গল্প বলার এটা এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাচীন প্রমাণ। সেই সময়ে মানুষের যে বিমূর্ত বিষয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা ছিল এই ছবিটি তারও প্রমাণ।"

বিজ্ঞানীদের দলটির নেতৃত্বে ছিলেন জাকার্তায় ন্যাশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন এজেন্সি (BRIN) এর ইন্দোনেশিয়ান রক আর্ট বিশেষজ্ঞ আদি আগুস ওকতাভিয়ানা। তিনি বলেছেন যে ইন্দোনেশিয়ায় বহু যুগ আগে থেকেই আদি মানব সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল কোন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গল্প বলার রীতি। তাঁর মতে “অবশ্যই মানুষ ৫১,২০০ বছরেরও অনেক আগে থেকে গল্প বলে আসছে, কিন্তু শব্দের যেহেতু জীবাশ্ম হয় না তাই আমাদেরকে পরোক্ষ প্রমাণ যেমন ছবির দৃশ্যাবলীর ওপর নির্ভর করতে হবে আর সেক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে সুলাওয়েসি চিত্র এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাচীন প্রমাণ।

(www.theoffnews.com Archaeology oldest European Rock Art)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours