শ্বেতা সরকার, লেখিকা, ইন্দা, খড়গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

ঈশ্বরের দেশ কেরলে প্রকৃতির মোহিনী রূপের ডালি মুন্নার। চা বাগান সমৃদ্ধ মুন্নারে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ গালিচায় মোড়া ঢেউ খেলানো পাহাড়, মেঘ বৃষ্টির হাতছানি আর ঝর্ণার ঝংকারে মানসিক পর্যায়ে আনন্দঘন আয়ু বেড়ে যায় দশ বছর। এই মুন্নারের সর্বশ্রেষ্ঠ আকর্ষণ হলো এরাভিকুলাম ন্যাশনাল পার্ক।

৯৭ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এই আরণ্যক উপন্যাস। যদিও শুরু ২২৭ বর্গ কিলোমিটার থেকে। ত্রিবাঙ্কুরের স্থানীয় রাজা পুঞ্জাতের কাছ থেকে সস্তায় জমি নিয়ে ইউরোপীয় পর্যটক কর্নেল ডগলাস হ্যামিল্টন ও জে ডি মুনরো ১৮৭৯ সালে এখানে স্থাপন করেছিলেন নর্থ ট্রাভাঙ্কুর প্লান্টেশন অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল সোসাইটি। ১৮৯০ সাল নাগাদ এখানের উঁচু অংশে লাগানো হয়েছিল চা গাছ। পাশাপাশি কফি, সিংকোনা ও ইউক্যালিপটাস—অবশ্যই স্বাভাবিক উদ্ভিদকে কিছুটা ধ্বংস করেই। স্বাধীনতার অনেকগুলো বছর পরে কেরল সরকারের হাতে এই জমি ফিরে এলে ‘কানন দেবন হিলস আইন’, ১৯৭১-এর সাহায্যে স্থানীয়দের মধ্যে তা বন্টনের ব্যবস্থা হয়। এর সাথে যুক্ত হন পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীরা। সেই পথেই আবার স্বাভাবিক উদ্ভিদ ও চাষবাস ফিরে আসে এবং অরণ্য অংশটি ১৯৭৫ সালে এরাভিকুলাম-রাজামালাই অভয়ারণ্য (Eravikulam National Park) নামে পরিচিত হয়। ১৯৭৮ সালে উন্নীত হয় জাতীয় উদ্যানে।

সম্পূর্ণ পার্কটি বন দফতরের অধীনে। এখানে প্রবেশের সময়: সকাল আটটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত। টিকিট কাউন্টার থেকে বন দফতরের বাসে চড়ে পনেরো মিনিটের পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে পৌঁছাতে হবে রাজামালা, এর পর প্রায় দুই কিমি পাকদণ্ডী হেঁটে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর পালা। একদিকে সবুজ গালিচায় ঢাকা পশ্চিমঘাট ধাপে ধাপে নেমে যাচ্ছে সমভূমির দিকে, আর অন্যদিকে পাহাড়ী পথ ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে আনাইমুড়ি চূড়ার দিকে। আনাইমুড়ি অর্থ হাতির মাথা। ২,৬৯৫ মিটার উঁচু দক্ষিণ ভারতের সর্বোচ্চ বিন্দু হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে এই হাতির মাথার মতো দেখতে চূড়া, প্রকৃতির শ্যামল শোভায় ডুব দিয়ে চার পাঁচ ঘন্টা ট্রেকিং করে চূড়ায় পৌঁছনো যায়। অবশ্যই বন বিভাগ থেকে পূর্বানুমতি নিতে হবে। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মন্টেন-শোলা তৃণভূমির সবচেয়ে বড় অংশটি এই এরাভিকুলাম জাতীয় উদ্যানে অবস্থিত। উচ্চতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্তরে স্তরে জল-জঙ্গল ঘিরে জলজ, স্থলজ উদ্ভিদ আর প্রাণী জড়ো হয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে গড়ে তুলেছে এক বিরাট বাস্তুতন্ত্র এবং প্রকৃতির এক মনমোহনী রূপ। চলার পথে পর্যটকদের স্বাগত জানাবে ছানা পোনা সমেত নীলগিরি তাহর বা থর। নীলগিরি তাহর বা থর হলো পশ্চিমঘাট পর্বতের একটি বিরল এবং বিপন্ন পার্বত্য ছাগল। ছোট, কালো, মোটা চুল এবং মানিযুক্ত এই বিপন্ন ছাগলের সংখ্যা প্রায় ৭৫০ টি । এই উদ্যানটি এদের আবাসস্থল। নীলগিরি তাহরের প্রজননের মরসুম ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত পার্কটি বন্ধ থাকে, এই বিপন্ন প্রজাতির সংরক্ষণের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এরা মানুষের উপস্থিতিতে অভ্যস্ত এবং শান্ত প্রকৃতির তাই ডোন্ট কেয়ার মনোভাব নিয়ে ছানা পোনা সমেত নিশ্চিন্তে পর্যটকদের ফটোগ্রাফির মডেল হয়ে যায়। নীলগিরি তাহর এবং নীলগিরি মার্টেন সহ পার্কে মোট ৪৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে, যার মধ্যে ১৭ টি পশ্চিমঘাটের স্থানীয়। মোট একশত তেত্রিশ প্রজাতির পাখি রয়েছে যার মধ্যে প্রায় এগারোটি প্রজাতি পশ্চিমঘাটে স্থানীয়। ইরাভিকুলাম জাতীয় উদ্যান প্রজাপতির জন্য বিখ্যাত। এই অঞ্চলে প্রায় একশো প্রজাতির প্রজাপতি শিক্ষাবিদরা চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে মাত্র ১১ টি পশ্চিমঘাটের স্থানীয়। এছাড়াও রয়েছে একুশটি প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে যার মধ্যে ১৭ টি ইরাভিকুলাম জাতীয় উদ্যানের প্রাণীজগতে স্থানীয় এবং বিরল প্রজাতির।

 চড়াই পথে হাঁটতে হাঁটতে আর ক্যামেরায় একের পর এক ছবি তুলতে তুলতে একটু এগোলেই দেখা মিলবে স্ফটিক স্বচ্ছ জলরাশির লাক্কাম জলপ্রপাতের সাথে। লাখাম বা লাক্কাম জলপ্রপাত একটি প্রাকৃতিক পশ্চাদপসরণ। এছাড়াও অনেক ছোট ছোট জলধারা এই পাহাড়ের গা বেয়ে পাম্বার নদী হয়ে পেরিয়ার ও কাবেরী নদীকে পুষ্ট করেছে। লাক্কাম জলপ্রপাতের হিম শীতল জলে হাত মুখ ধুয়ে ক্লান্তি জুড়িয়ে আবার চড়াইয়ের পথে হাঁটা শুরু। এরপর বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই নীলা কুরিঞ্জির বাগান।

প্রকৃতির বিস্ময় এই নীলা কুরিঞ্জি ফুল যা বারো বছরে একবার ফোটে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩০০ থেকে ২৪০০ মিটার উঁচু পাহাড়ের ঢালে ৩০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার উচ্চতায় এই বন্য ফুল জন্মায়। ফুলটি গন্ধহীন এবং এর কোনও ওষধি মূল্য নেই। বেগুনি-নীল নীলাকুরিঞ্জি ফুলের নাম অনুসারে নীলগিরি বা "নীল পর্বত" নামকরণ হয়েছে। বহুবর্ষজীবী গুল্ম জাতীয় এই গাছটি সাধারণত ৩০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার উঁচু হয়, কখনও কখনও ১৮০ সেন্টিমিটারেরও বেশি বৃদ্ধি পায়। কিছু বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদের একবারই ফুল ফোটে, বীজ হয় এবং মারা যায়। এই বীজ থেকে উদ্ভিদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্ম হয়। এই জাতীয় গাছগুলি মনোকারপিক নামে পরিচিত। মনোকারপিক উদ্ভিদে পরিপক্কতা অর্জনের পরেই ফুল ফোটে। বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষেত্রে এই সময় ভিন্ন ভিন্ন হয়। আমাদের পরিচিত উদ্ভিদের মধ্যে বাঁশ হল মনোকারপিক উদ্ভিদ যা পরিপক্ক হতে এবং ফুল হতে ৪০ বছরেরও বেশি সময় নেয়। কুরিঞ্জিও এই জাতীয় উদ্ভিদ। ভারতে অন্তত ছেচল্লিশটি প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়। নীলাকুরিঞ্জি ১২ বছরের মধ্যে পরিপক্ক হয় এবং প্রতি ১২ বছর পর পর ফুল ফোটে। তবে কিছু প্রজাতিতে পাঁচ বছর বা ষোল বছর পর পর ফুল ফোটে। তাই ফুলে ফোটার দশ মাস পরে বীজ পরিপক্ক না হওয়া পর্যন্ত গাছ বা এর শুকনো ডালগুলির কোনও ক্ষতি যাতে না হয় তা কঠোরভাবে দেখা হয়।

মুন্নারের মুথুভা এবং নীলগিরির টোডাস উপজাতি কুরিঞ্জির ফুলকে শুভ বলে মনে করেন। স্থানীয় উপজাতি মুথুভাস এবং টোডাসের পৌরাণিক কাহিনী এবং সংস্কৃতিতে এই ফুলের একটি উল্লেখযোগ্য স্থান রয়েছে। বিশ্বাস করা হয় প্রভু মুরুগার একটি আদিবাসী মেয়েকে কুরিঞ্জি ফুলের মালা উপহার দিয়ে বিয়ে করেছিলেন। এই পৌরাণিক কাহিনীর উপর ভিত্তি করে এই ফুলগুলি প্রেম এবং আবেগের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

নীলা কুরিঞ্জিকে পিছনে ফেলে পাহাড়ী পথ বেয়ে পর্যটকেরা এসে পৌঁছবেন তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া অঞ্চলের শেষ প্রান্তে। যেখানে গোটা গোটা অক্ষরে বোর্ডে লেখা "HERE IS THE LIMIT", যা বাংলা তর্জমায়, 'এখানেই শেষ প্রান্তর'l টেবিলের মতো সমতল একটি জায়গা। যার প্রান্তে দাঁড়িয়ে মনে হয়, 

"স্তব্ধ সর্ব কোলাহল, শান্তিমগ্ন চরাচর--

এক তুমি, তোমা-মাঝে আমি একা নির্ভয়ে।"

(www.theoffnews.com Kerala Eravikulam National Park Neelakurinji)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours