সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:
কথায় বলে, অতি লোভে তাঁতি মরে।
এই বাংলা প্রবাদ যে কতখানি ধ্রুব সত্য তা কিন্তু আমাদের সমাজে আজও প্রমাণ পাওয়া যায় ভুঁড়ি ভুঁড়ি। কত শত মানুষ জীবনের সমস্ত সঞ্চয় খুইয়ে বসেন হামেশাই এক লহমায়। প্রতারিত ফিনান্সিয়াল সংস্থার দৌলতে। কারণ সংস্থাগুলো অস্বাভাবিক হারে সুদ সমেত আসল ফেরত দেবে আমানতকারীদের, এমন প্রচার করে থাকে জনমানসে। ব্যাস্ রাতারাতি বড়লোক হবার স্বপ্ন দেখা শুরু। আর অচিরেই ফকির হওয়া শেষ পর্যায়ে। এই অতি লোভে তাঁতি মরে ট্র্যাডিশন তাই আজও অব্যাহত আমাদের সমাজের আনাচে কানাচে। বিনিয়োগের মায়াবী পাতা ফাঁদে। তাহলে মুক্তির উপায়?
হ্যাঁ এহেন সমস্যার থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে মহানগরের গত সোমবার সন্ধ্যায় এক অর্থনৈতিক আলোচনার আসর বসেছিল ক্যালকাটা ক্লাব লিমিটেডে। সচেতনতা মূলক এই আলোচনা চক্রের আয়োজন করে ছিল যৌথ উদ্যোগে রোটারী অফ ক্যালকাটা ইনার সিটি ও রোটারী অফ ক্যালকাটা মেট্রো সিটি। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল, হাও টু ইনভেস্ট সেফলি।
গুরুত্বপূর্ণ এই আলোচনায় উঠে আসে কি বিপুল পরিমাণ আমানতকারীদের সঞ্চয় এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন ভুয়া সংস্থার কাছে গচ্ছিত রয়েছে। একটা পরিসংখ্যানে জানা গিয়েছে, সত্যম কম্পিউটার সার্ভিসেস ৭,০০০ কোটি টাকা, পঞ্জাব এন্ড মহারাষ্ট্র কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক ৪,৩৫৫ কোটি টাকা, ন্যাশনাল স্পট এক্সচেঞ্জ লিমিটেড ৫,৬০০ কোটি টাকা সহ পঞ্জি স্কিমের অন্তর্ভুক্ত সারদা গ্রুপ ২,৫০০ কোটি টাকা ও রোজ ভ্যালি গ্রুপ ১৭,০০০ কোটি টাকা সঞ্চয়কারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধাপে। অথচ এই কোম্পানিগুলো পুরোপুরি জাল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
সচেতনতা মূলক এই আলোচনায় অংশ নিতে গিয়ে ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (এনএসই)' এর কলকাতা চ্যাপ্টারের অন্যতম ম্যানেজার সৌমী সাহা বলেন, "সম্প্রতি স্যোশাল মিডিয়া তথা, টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে বহু গ্রুপে বিপুল সংখ্যক লোভনীয় প্রচার দেখানো হয়। বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করার জন্য অস্বাভাবিক হারে রিটার্ণের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। এক ঝলক দেখলে মনে হবে এরা হয়তো প্রকৃতই নিরাপদ সংস্থা। এমনকি এরা সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (সেবি)'র জাল নথিও পেশ করে সঞ্চয়কারীদের আস্থা অর্জনের উদ্দেশ্যে। তাই এইসব ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকারীদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকি সম্পন্ন।" তিনি উল্লেখ করেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেও এই সমস্ত ভুয়ো সংস্থার বিরুদ্ধে সেবির আদতে কিছুই করার থাকে না। কারণ ওই সংস্থাগুলো প্রকৃতপক্ষে সেবির নথিভুক্ত রেজিস্ট্রিকৃত সংস্থাই নয়। এখানে প্রতারিত হলে শুধুমাত্র পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগে নালিশ জানানো ছাড়া আরও কোনও বিকল্প থাকে না আমানতকারীদের সামনে।
কলকাতা বিভাগের এনএসই'র অপর ম্যানেজার চিন্ময় চিরসুন্দর মল্লিক আলোচনায় অংশ নিয়ে পরিসংখ্যান সহযোগে জানান, ২০২৩ সাল থেকে দেশের বিভিন্ন শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের হার উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আনুপাতিক হারে সেই বিনিয়োগের মাত্রা উর্দ্ধমুখী হয়নি। তাঁর মন্তব্য, ন্যাশনাল সিকিউরিটিজ ডিপোজিটোরি লিমিটেড ও সেন্ট্রাল ডিপোজিটোরি সার্ভিসেস লিমিটেডের তরফে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে যেখানে ২০২৩ সালে সারা দেশের নিরিখে শেয়ার বাজারে মোট বিনিয়োগকারীর ডিম্যাট অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ১১ কোটি, সেখানে এই রাজ্যে ডিম্যাট অ্যাকাউন্টধারী শেয়ার ক্রেতার সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ লক্ষ। অন্য একটি তথ্যানুসারে জানা গিয়েছে, সমগ্র ভারতে শেয়ার বাজারের মোট রেজিস্ট্রিকৃত শেয়ার ব্রোকারের সংখ্যা ১৫,৯৫০ হলেও এরাজ্যে তা মাত্র ১০০'তে সীমাবদ্ধ। চিন্ময়বাবুর বলেন, "বর্তমানে ভারতের শেয়ার বাজার আক্ষরিক অর্থে প্রকৃতই তেজী বুলে পরিণত হয়েছে। দেশীয় শেয়ার বাজারে ভারতীয় মুদ্রায় সম্প্রতি মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৩০০ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে এই বিনিয়োগের পরিসংখ্যান স্রেফ ৩ লক্ষ কোটি টাকা।"
এই আলোচনায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে এনএসই'র হায়দ্রাবাদ শাখার কর্মরত ম্যানেজার মোহিনী মুখোপাধ্যায় শ্রোতাদের সতর্ক করে জানান, যে কোনও বিনিয়োগের আগে তা কতটা ঝুঁকি পূর্ণ তা আগে যাচাই করা উচিৎ পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে। অতিরিক্ত হারে ফেরতের প্রতিশ্রুতি দিলেই সরাসরি বিনিয়োগ করতে যাবেন না। লগ্নিকারী সংস্থার নির্ভরযোগ্যতা সর্বাগ্রে খতিয়ে দেখা উচিৎ। সেই সংস্থা আদৌ দেশের স্টক এক্সচেঞ্জগুলো সহ সেবি এবং এনএসই'র রেজিস্ট্রিকৃত কিনা তাও পরখ করে দেখা প্রয়োজন। সেবি, এনএসই সহ শেয়ার বাজারে লগ্নিকারী সংস্থার রেজিস্ট্রেশন নম্বর পরীক্ষা করা অবশ্যই প্রয়োজন ওই সমস্ত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে। এমনকি এক্ষেত্রে ক্রশ ভেরিফিকেশন খুব জরুরি। এক্ষেত্রে নিশ্চিত না হলে, ওই সংস্থায় বিনিয়োগের পরিকল্পনা বর্জন করা আবশ্যক। সুতরাং বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও লোভে পাপ পাপে মৃত্যু আপ্তবাক্যটি সব সময়ে স্মরণে রাখবেন।
(www.theoffnews.com Rotary Club Calcutta Club Limited stock market invest)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours