মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও লেকচারার, আহমেদাবাদ:
অতি সম্প্রতি কাগজে একটা খবর দেখে চমকে গেলাম, এখান থেকে খানিক দূরে নাদিয়াড নামে এক জায়গায় এক দম্পতি (জাতে সোনার, পদবী সোনি) প্রতিবেশী ২৯ বছরের মেয়েটিকে খুন করেছেন, গলার সাত ভরি ওজনের একটা সোনার চেইনের লোভে। মেয়েটি সাউথের, স্বামীর বাসনের ব্যবসা, ঘুরে ঘুরে কাজ। অনেক রাতে বাসায় আসেন। সোনি দম্পতি রান্নার ব্যবসা করে, হোম ডেলিভারি, কভিডের পরে কাজ ভালো চলছে না।সম্প্রতি ধার দেনা করে জর্জরিত।
মেয়েটি মাঝে মাঝে রান্না শিখতে আসত, সেদিন তাকে সন্ধ্যের পর ডেকে পাঠায় সোনিরা। তারপরে মাথায় আঘাত করে জলে বডি ফেলে আসে।
পুরো ঘটনার মধ্যে নতুনত্ব সোনি দম্পতি "দৃশ্যম" মুভি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ঠিক সেভাবেই ঘটনা সাজিয়েছেন। খুনের দিন তারা বাড়ি ছিলেন না, সপরিবারে ঘুরছিলেন, টিকিট আছে, সাক্ষী আছে। পুলিশ থমকে গেছিল ঠিকই কিন্তু বডি ভেসে উঠল তিন দিনের মাথায়, মাটিতে পুঁতে দিতে পারেনি।
মেয়েটির স্বামী পুলিশে রিপোর্ট লিখিয়েছিল, তারপর জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছে ভেবে মনের দুঃখে সাউথে ফিরে যায়। কিন্তু পুলিশ তো আর মুভির পুলিশ নয়, ধরা পরে গেছে সোনি দম্পতি।
আমার প্রশ্ন মুভি থেকে অনুপ্রাণিত হওয়া নতুন কথা নয়, কিন্তু ক্রাইম মুভি দেখে ক্রাইম করতে উৎসাহিত হলে কিন্তু সেটা খুব আশাব্যঞ্জক নয়।
আমি নিজে ক্রাইম থ্রিলারের ভক্ত, সমস্যার সমাধান করতে ভালই লাগে, দৃশ্যমেও সহানুভূতি ছিল নায়কের ওপর, লাচার বাবা! কিন্তু পুলিশকে বোকা বানানো অবধি ঠিক আছে কিন্তু ক্রাইম করে পার পাওয়া যায় এই মেসেজ যদি নিম্ন মধ্যবিত্ত, অর্থকষ্টে জর্জরিত মানুষরা খড় কুটোর মত আঁকড়ে ধরে, তবে সেটা বোধহয় ঠিক নয়। এক্ষেত্রে মুভি বানানোর সময় পরিচালক থেকে গল্পকার সবারই সেটা মাথায় রাখা উচিৎ।
আমি বলছি না রাজা হরিশ্চন্দ্র দেখাতে, "কিন্তু চুরি করা মহাবিদ্যা যদি না পড়ো ধরা অথবা খুন করতেও পারও কিন্তু প্রমাণ লোপাট করতে হবে সঠিক ভাবে।" এমন মেসেজ ছড়ালে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটতেই পারে কিন্তু আকছার।
স্বল্প বুদ্ধির মানুষ মুভিটি কোন মানের, তার গুণগত মান কত খানি এসব তলিয়ে ভাবেন না, মরাল অফ দি স্টোরিটুকুই গ্রহণ করে বোধহয়, তাই এই ট্রেন্ডটা মুভির মত গণ মাধ্যমে বেশি না আসাই ভালো মনে হয়।
আসলে মুভির চরিত্রটি অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের হওয়ায় বোধ হয়, দর্শক একটু বেশিই একাত্মতা অনুভব করে ফেলেছেন। মনে পড়ে গেল থ্রি ইডিয়টসের পরে কি পরিমাণ ছাত্র ছাত্রীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছিল।
সুন্দর মুভি বানিয়ে দর্শককে উপহার দিতে চায় সব পরিচালকরাই, তবে সমাজের প্রতি একটা দায়িত্বও যে থেকে যায় তাঁদের!
বহুরূপী ছবিটি দেখলাম, বেশ ভালো লাগল, গ্রামবাংলার কথা, হারিয়ে যাওয়া বহুরূপীদের কথা শিবপ্রসাদ, নন্দিতরাই তুলে আনলেন কিন্তু কাগজে ওই মর্মান্তিক ঘটনা পড়ে ভাবছিলাম কেউ না আবার ভাবে ব্যাঙ্ক ডাকাতি দোষের নয়, সরকারের টাকাই তো। আসলে ক্রম বর্ধমান খরচ সামলে উঠতে হিমশিম খেতে খেতে এমন কিছু ঘটনা নিয়ে মুভি দেখলে সাধারণ মানুষ সেটাকেই সমাধান ভেবে নিতেই পারে। তাই শুধু জনপ্রিয় বানাতে গিয়ে অজান্তে ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে কিনা ভাবার সময়ও আসছে কিন্তু।
সুস্থ সমাজ গড়ার কাজ তো সব শিল্পীদেরই, বর্তমানে লেখা থেকে মুভি সবেতে অশ্লীল শব্দের কদর্য ব্যবহার এত বেশি বেড়ে গেছে যে তার প্রতিফলন চারপাশের কথোপকথন থেকেও বেশ টের পাওয়া যায়। কিন্তু সেই সব লেখা বা মুভি কি কালজয়ী হতে পারছে? আজও তো ক্লাসিকের পর্যায়ে তারা উন্নীত হতে পারছে না।
আমাদের বোধহয় একটু সাবধানে কলম চালানো বা মুভি তৈরি করার সময় এসেছে।
(www.theoffnews.com Nadiad murder film)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours