রণজিৎ গুহ, লেখক ও সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:

(লেখক একজন গর্বিত প্রাক্তন ইস্পাত কর্মী)

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয় প্রতিবছর ২১শে ফ্রেব্রুয়ারি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে বাংলা ভাষা সম্পর্কিত রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের জেরেই এই দিবস সারা বিশ্বের বাংলাভাষী সমাজের আজও তীব্র আবেগের। সুদূর পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনেও বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা অর্জন করেছে। সর্বশেষে ভারত সরকার ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিল চলতি বছরের ৩রা অক্টোবর। এছাড়া বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় প্রচলিত ভাষাগুলির মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান সপ্তমে। এমতাবস্থায় বাংলা ভাষার আদিপর্ব নিয়ে না হয় খানিক তত্ত্বতালাশ করাই যাক।

বাংলা ভাষার লিখিত সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ'এর বয়স প্রায় ১২০০ বছর। অবশ্য চর্যাপদ কোন ভাষায় লেখা তা নিয়ে কিছু মতভেদ আছে।যদিও সুনীতি চট্টোপাধ্যায় নিশ্চিত ভাবে প্রমাণ করেছেন যে চর্যাগীতির পদগুলো বাংলা ভাষাতেই লেখা। অন্যতম পদকর্তা ভুলুক পা নিজেকে বাঙালি বলেই পরিচয় দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্য না হয় ১২০০ বছরের পুরানো প্রমাণিত হল, কিন্তু বাংলা ভাষার বয়স কত? পণ্ডিত গবেষক মহল এ'ব্যাপারে স্পষ্ট ভাবে এখনও  কিছু জানাতে পারেননি । সাহিত্য রচনার অনেক আগেই নিশ্চয়ই লিপি বা বর্ণমালা তৈরি হয়েছে। না হলে লেখা হবে কিভাবে?অবশ্যই তারও অনেক অনেক আগে লোকমুখে বাংলা কথ্য ভাষার চলন শুরু হয়েছে। ক্রমে বাংলা গল্পগাছা বা মৌখিক সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। তারপর এলো বাংলা হরফ। গবেষকরা জানিয়েছেন বাংলা লিপি সম্রাট অশোকের ব্রাহ্মি লিপিরই বিবর্তিত  রূপ। অষ্টম শতাব্দীর পাল সাম্রাজ্যের দলিল দস্তাবেজ, তাম্রলিপি, শিলালেখ বা মন্দির গাত্রের লেখায় অধিকাংশ বর্ণ বর্তমানের বাংলা লিপির বর্ণগুলোর মতই। বঙ্গাব্দ প্রবর্তক রাজা শশাঙ্ক সপ্তম শতাব্দীর গোড়াতেই যে স্বর্ণমুদ্রা চালু করেন তাতেও বাংলা হরফের আভাস পাওয়া যায়। বাংলা হরফের প্রাচীনত্বর কিছুটা আভাস পাওয়া গেলেও বাংলা ভাষার উৎপত্তির সঠিক সময়কাল অজানাই থেকে যায়। আজকের দিনে যে অঞ্চলের বাসিন্দাদের বাঙালি বলা হয় তার প্রথম উল্লেখ ৩০০০ বছর পুর্বের ঐতরেয় আরণ্যক'গ্রন্থে 'বঙ্গ' শব্দে পাওয়া যায়। বাংলার  উল্লেখ পাই ১০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দের কাছাকাছি গ্রিকদের লেখায়। হিউয়েন সাং শক্তিশালী  সামরিক ও বাণিজ্যিক শক্তি বলে উল্লেখ করেছেন এই অঞ্চলের। কোন ভাষায় কথা বলতেন এই অঞ্চলের মানুষেরা? প্রায় বুদ্ধ সমসাময়িক বাঙালি বিজয় সিংহ যে বর্তমানের শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে গেছিলেন তিনি কোন ভাষায় কথা বলতেন? সম্ভবত প্রাগ বুদ্ধ বা প্রায় বুদ্ধ সমসাময়িক পাণিনি যে ভাষাগুলোর সংস্কার করে সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ কাঠামো তৈরি করলেন, সেই ভাষাগুলোর অন্যতম কি বাংলাও ছিল? সর্বজন মান্য বুদ্ধ জীবনী ললিতবিস্তার'এ জানা যায় বুদ্ধদেব অন্যান্য ভাষার সাথে বঙ্গলিপি শিখছেন। বঙ্গলিপি মানে নিশ্চয়ই লেখালেখির বর্ণমালা নয়। তাহলে সে লিপির পালি বা সংস্কৃত ভাষার মতন কোনও না কোনও নিদর্শন পাওয়া যেত। ললিতবিস্তার'এ উল্লেখিত বঙ্গলিপি বঙ্গভাষা বোঝাতেই লেখা হয়েছে। অর্থাৎ  বাংলা ভাষার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ আজ থেকে ২৫০০ বছর আগেও একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলতেন? পণ্ডিত মহল সাধারণ ভাবে এই অঞ্চলের সেই সময়কার প্রচলিত ভাষাকে প্রাকৃত বলে চিহ্নিত করেছেন। প্রাকৃত ভাষা মানে প্রাকৃতজন'এর কথ্য ভাষা। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ভাষা। সেই ভাষা অনিবার্য ভাবে আজকের মান্য বাংলা ভাষার সাথে চেহারায় মিলবে না। শব্দ, বাক্য গঠন, বিশেষ্য বিশেষণ ক্রিয়াপদ এর ব্যাপক পরিবর্তন স্বাভাবিক ভাবেই অনেক পালটে যাবে। কিন্তু ২০০০ থেকে ২৫০০ বছর আগে ভারতের পূর্বাংশে গঙ্গা অববাহিকায় বসবাসকারী মানুষজনের মুখের ভাষার কোনও পাথুরে প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। ফলে জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না কবে থেকে বাঙালি বাংলা ভাষায় কথা বলে। প্রকৃতপক্ষে কবে থেকে আমাদের আজকের মাতৃভাষা বাংলা নামে পরিচিত? প্রসঙ্গত অন্য একটা প্রশ্নও এসে পড়ে। বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষদের বাঙালি বলা হবে, না একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডর বাসিন্দাদের বাঙালি বলা হবে? যাদের বর্তমান কথ্য ভাষার নাম বাংলা?

(www.theoffnews.com - Bengali classical language)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours