সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:
(প্রচলিত লোককথা)
একদা গ্রীষ্মকালে শিষ্য তুলসী গুরুদেবের কাছ থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিল। অনেক দূরে তার গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত তাকে হেঁটেই যেতে হবে।
অর্ধদিবস হাঁটার পর সে অসহ্য তৃষ্ণা অনুভব করল আর তার চারপাশে জলের উৎসের সন্ধান করতে লাগল। শীঘ্রই সে একটি কূপের সন্ধান পেয়ে সেটি থেকে জল উত্তোলন করল। জলপানের পর তার নিজেকে খুব তরতাজা মনে হল কারণ ওই কূপের জল ছিল খুব মিষ্ট এবং শীতল।
জলপানের অনতিবিলম্ব পরেই গুরুদেবের সুস্মিত আননটি তার চিত্তপটে উদিত হল। ফলত সে তার ক্ষুদ্র মশকে (চর্মনির্মিত জলপাত্র) ওই কূপের জল সংগ্রহ করে আশ্রমের দিকে ফিরে চলল।
আশ্রমে পৌঁছে শিষ্য তুলসী গুরুদেবকে সমস্ত আখ্যান বর্ণনা করল আর জলভর্তি মশকটি তাঁকে হস্তার্পণ করল। গুরুজী ওই কূপবারি পান করে শিষ্য তুলসীর দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি প্রদান করলেন। অতঃপর গুরুদেব তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, “সত্য এই কূপবারি সুপেয়, সুমিষ্ট এবং শীতল। আমার প্রাণ জুড়িয়ে গেল। আমার নিজেকে খুব তরতাজা লাগছে”।
গুরুদেবের এমত প্রশংসা বাক্য শুনে তুলসী তো যারপরনাই আহ্লাদিত হল। সে পুনরায় গুরুদেবের থেকে আশ্রম নির্গমনের অনুমতি ভিক্ষা করে তার গ্রামের উদ্দেশে প্রাগ্রসর হল।
সে আশ্রম থেকে নির্গত হতেই অন্য এক শিষ্য যে এই কথোপকথন এতক্ষণ নিঃশব্দে অনুসরণ করছিল, গুরুদেবের সমীপে ওই বারি পান করার অভিলাষ ব্যক্ত করল।
গুরুদেব অতঃপর মশকটি ওই শিষ্যকে প্রদান করলেন।
শিষ্যটি এক গন্ডূষ কূপবারি মুখে দেওয়া মাত্রই এক থুৎকারে সেটি মুখের বাইরে নিক্ষেপ করল আর আশ্রমের সুজলে মুখ প্রক্ষালন করল।
অতঃপর শিষ্যটি গুরুদেবকে অনুযোগ জানাল, “গুরুদেব, এই কূপবারি অত্যন্ত কটু স্বাদের এবং শীতলও নয়। কি কারণে আপনি এই উৎকট বারির নিমিত্ত ওর এত প্রশংসা করলেন?”
গুরুদেব প্রত্যুত্তর করলেন, “বৎস, বারিতে মিষ্টত্ব এবং শীতলতা না আছে তো কি হয়েছে, যে ব্যক্তি এটি বহন করে নিয়ে এসেছে তার আবেগের আসল গুরুত্ব। যে মুহূর্তে তুলসী ওই কূপের উদক পান করে উজ্জীবন লাভ করে তৎক্ষণাৎ তার চিত্তপটে আমার আননখানি ভাসিত হয় এবং তার হৃদয়ে ভালবাসার জন্ম হয়। সে সেই সুস্বাদু বারিপানের আনন্দ আমার সঙ্গে বাঁটোয়ারা করে নিতে চায়। এই অনুভবটাই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তোমার মত আমারও ওই বারির স্বাদ ভাল লাগেনি কিন্তু সেই রূঢ মন্তব্য করে আমি তার অনুভূতিকে আঘাত করতে চাইনি। সম্ভবত ওই মশক যখন বারিপূর্ণ করা হয়েছিল তখনই এটির স্বাদ বদলে যায় কারণ মশকটি অপরিষ্কৃত থাকার কারণে সুপেয় বারি আবিল বারিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শুধু সেই তুচ্ছ কারণে যে ব্যক্তি এটি বহন করে নিয়ে এসেছিল তার ভালবাসা এতটুকু হ্রাস পায়নি”।
(www.theoffnews.com moral story folk tales)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours