পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
মাস ছয়েক আগের ঘটনা আমি হাওড়ার বাগনান যাব একটি সেমিনারে। উদ্যোক্তারা আমায় বললেন, ‘আপনি কিন্তু ভুল করেও ট্রেনে আসবেন না। বাসে আসার চেষ্টা করবেন। এখানে ট্রেনের কোনও ঠিক ঠিকানা নেই। ইচ্ছে মত চলে।‘ কথাটা ঠিক বিশ্বাস হল না, আমি আগে এদিকে বহুবার লোকাল ট্রেনে গিয়েছি সুন্দর ফাঁকায় ফাঁকায় যাওয়া যায়। তাই ওদের কিছু না বলে হাওড়া দিয়ে ট্রেনেই যাব বলে বেরোলাম। হাওড়ায় পৌঁছলাম সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ। ঢুকে দেখলাম বোর্ডে দেওয়া নটা পয়তাল্লিশের মেদিনীপুর লোকাল। একটু অবাক হলাম নটা পয়তাল্লিশের ট্রেন সাড়ে দশটাতেও ছাড়েনি? প্ল্যাটফর্মে গিয়ে আরও অবাক। থিকথিক করছে ভিড়, সেই ট্রেন এখনও প্ল্যাটফর্মে ঢোকেইনি। এর পরে সপ্তাহ খানেক আগেও সেই একই গল্প হাওড়া বর্ধমান শাখাতেও। লোকাল ট্রেনই দেড় দুই ঘন্টা লেটে চলছে। শুধু কি লোকাল ট্রেন? দূর পাল্লার ট্রেনের অবস্থাও তথৈবচ। প্রায় একই অবস্থা শিয়ালদহ শাখাতেও। শীতকালে কুয়াশার জন্য অনেক সময় ট্রেন লেট হতো। কিন্তু এখন শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সব সময়েই ট্রেনের বিলম্বে চলাটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের রেলমন্ত্রী উচ্চশিক্ষিত। বালেশ্বরে ট্রেন দুর্ঘটনার সময়ে তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে উদ্ধার কার্যে তদারকি করেছেন স্যোশাল মিডিয়ায় তার প্রশংসার বন্যা বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন যে ট্রেনের সময় সারণীর মা মাসি এক হয়ে গিয়েছে সে বেলা তার কোনও পদক্ষেপ লক্ষ্য করিনি। বছর খানেক আগে বন্দে ভারত উদ্বোধন করে এমন একটা প্রচার করা হল যেন মনে হল, ভারতে এর আগে ট্রেনই চলত না। সেই ট্রেনকে নিয়ে একটা দেশ প্রেম গোছের আবেগ উন্মাদনা সুকৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হল জনমানসে। মানুষও ভেসে গেল সেই আবেগের সুনামিতে। বন্দে ভারত চাপার ধুম পড়ে গেল, স্টেশনে স্টেশনে ওই ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলাটা নিয়মে পরিনত হল। চারিয়ে দেওয়া হল একটাই কথা মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। অন্য ট্রেনের গতি কমিয়ে দিয়ে, স্টপেজ বাড়িয়ে দিয়ে বন্দে ভারতকেই সেরা ট্রেন হিসেবে প্রমাণ করবার চেষ্টা করা হল। আনা হল অমৃত ভারত। রেল তৎপর এই ট্রেনগুলিকে সময়ে চালাতে। বাকি অন্য ট্রেন ছাগলের তৃতীয় সন্তান এখন। তারা কখন যাবে, কখন আসবে এই নিয়ে রেলের কোনও মাথা ব্যাথা আছে বলেও মনে হয় না।
এখন আর রেল বাজেট আলাদা করে হয় না। সাধারণ বাজেটে তাই নতুন ট্রেন বা অন্য ঘোষণা কমই থাকে। এবারের বাজেটে পশ্চিমবঙ্গের জন্য দুই হাজার কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে বলে রেলমন্ত্রী জানিয়েছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের অভিযোগ লোকাল ট্রেন বাড়ানো হয়নি। সময়ে ট্রেন চালানো শিকেয় উঠেছে। শুধু ট্রেন এক গাদা বন্দে ভারত বা অমৃত ভারত বাড়িয়ে চমক দেওয়া হচ্ছে। গত কয়েক বছরের মতো এবারও রাজ্যের একাধিক রেলপ্রকল্পে মাত্র এক হাজার টাকা করে বরাদ্দ করা হয়েছে। তারকেশ্বর-মগরা, তারকেশ্বর-ফুরফুরা শরিফ, বারুইপুর-মানাপুর ভায়া খড়গপুর, লছিমপুর-বারহাট, হাসনাবাদ-হিঙ্গলগঞ্জে নতুন রেলপথ বা লাইন ডাবলিংয়ের জন্য মাত্র এক হাজার টাকা করে বরাদ্দ হয়েছে। হাবড়া-বনগাঁ-ফেস ১ এবং মছলন্দপুর-স্বরূপনগর, সোনারপুর-ক্যানিং এবং কালিকাপুর-মিনাখাঁ ভায়া ঘটকপুর রেল পথের মডিফিকেশনের জন্যও বরাদ্দ হয়েছে এক হাজার টাকা করে। লালগোলা-মণিগ্রাম, লালগোলা-জিয়াগঞ্জ ও সাইঁথিয়া-তারাপীঠ তৃতীয় লাইনের জন্যেও বরাদ্দের পরিমাণ মাত্র এক হাজার টাকা।
অসংখ্য প্যাসেঞ্জার ট্রেনকে এক্সপ্রেস তকমা দিয়ে তাদের ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ সময় একই আছে। করোনার আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া বেশ কিছু ট্রেন এখনও চালুই করা হয়নি। তুলে দেওয়া হয়েছে বয়স্কদের ছাড়ের সুবিধা। ডিসেম্বর থেকে নিঃশব্দে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ট্রেন টিকিট
বাতিলের খরচ। বড় স্টেশনে এখন নিখরচায় ওয়েটিং রুম তুলে দিয়ে সেখানে অর্থের বিনিময়ে বসার ব্যবস্থা করে হয়েছে। ট্রেনের খাবারের মান দিন দিন খারাপ থেকে অতি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এসবই কিন্তু সাধারণ মানুষের অভিযোগ। মোদি জমানায় আচ্ছে দিনে রেলের এমনই বেহাল দশা দেখে হতাশ সাধারণ মানুষ। লোকাল ট্রেন চুলোয় যাক, এখন সবাই আসুন আচ্ছে ভারতের থুড়ি, বন্দেভারতের স্বপ্ন দেখি।
(www.theoffnews.com Indian railways achchhe din)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours