সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

কলকাতার অভয়া কান্ডে চিকিৎসক আন্দোলনকারীরা স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও পুলিশমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি এখনও করছেন না কেন? এই দাবি যাতে অন্য কেউ তুমুল পর্যায়ে হাইজ্যাক না করতে পারে, তাই আন্দোলনের অভিমুখ উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে ঘোরানো হচ্ছে না তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্যাডো হিসেবে! কি অদ্ভুত আশ্চর্য এই আন্দোলনের আপাতত নির্যাস, অভয়ার প্রতি কলকাতার পুলিশের ন্যক্কারজনক লুকোচুরি স্ট্যান্ড, আরজি কর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের লাগামহীন চক্রান্ত সংযোগ নিয়ে আন্দোলনকারীদের সেই গত কয়েকদিনের উচ্চগ্রাম কোথায় যেন ভ্যানিশ হয়ে গেছে। মহিলাদের রাত দখলেও কেমন কেমন যেন সুপ্ত ভাঁটার পূর্বাভাস। রাজনৈতিক দলগুলোও যেন শামুকের খোলে ঢুকে গেছে এক হতবাকের আকস্মিকতায়। আমরা মাঠে আছি, এটুকু দেখনদারিতেই দায় সারছে সরকার বিরোধী সব দলের নেতারা। মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবিটাই যেন ফানুসের মতো বাতাসে মিলিয়ে গেছে হঠাৎ এক পরিকল্পিত রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। অথচ মুখ্যমন্ত্রীর দায়বদ্ধতা নিয়ে সভ্য সমাজে অন্তত এই ইস্যুতে প্রশ্ন ওঠারই কথা ছিল স্বাভাবিক ভাবে। কিন্তু কোথায় কি? ছাত্রদের নবান্ন অভিযান তো এখন ফসিলের স্মরনিকায় স্থান পেয়েছে। এদিকে মুখ্যমন্ত্রীর পাঠানো পুলিশি নিরাপত্তায় একাংশ আন্দোলনকারীরা শুধু বাসে চেপে যাচ্ছেন আর আসছেন। কখনও কালিঘাট। কখনওবা গঙ্গাপাড়। নিমরাজি হয়ে বেশকিছু দাবিও মেনে নিচ্ছে প্রশাসন। শুধু সময় অতিবাহিত হয়েই চলেছে। আর অভয়ার প্রতি অবিচারের বিচার দাবি ক্রমাগত আবছা থেকে আরও আবছাতর হতে চলেছে আন্দোলনকারীদের সাম্প্রতিক আচরণে। নাতো কোথায় তোলা হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি। নাতো কোথায় তোলা হচ্ছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে উচ্চস্বর। নাতো কোথায় তোলা হচ্ছে জড়ালো পর্যায়ে পুলিশমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি। এরা বাস্তবে আক্ষরিক অর্থেই আন্দোলনের নামে প্রকৃতই কি সাচ্চা আন্দোলন করছেন? জনমানসে সন্দেহের বাতাবরণ কিন্তু এব্যাপারে স্পষ্ট উঁকি দিচ্ছে ঠারেঠোরে। পরিস্থিতি যা, যদি কেউ আচমকা অভিযোগ করেও বসেন যে, প্রশাসনের ছায়া চর হয়ে আন্দোলনের নামে জাস্ট উল্টো গেম খেলছেন আর আপমর বাঙালিকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছেন কতিপয় আন্দোলনকারী, তবে আমি অন্তত এই মুহূর্তে হতবাক হবো না। কেন কেন কেন আন্দোলনকারীদের দাবিতে সর্বাগ্রে স্থান পাবে না অভয়ার ইস্যুতে চক্রান্তকারীদের গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গগুলি। কেন পুলিশমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন তোলা হবে না, বাবা মার অনুমতি ছাড়া মৃতদেহ চটজলদি জ্বালিয়ে দেবার বিষয়ে পুলিশের অতি তৎপরতা কোন তাগিদে? কেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন তোলা হবে না, দ্রুততার সঙ্গে পদত্যাগী সন্দীপ ঘোষকে কিসের স্বার্থে প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া হলো? কেন তৃণমূল সুপ্রিমোর কাছে প্রশ্ন তোলা হবে না, শশ্মাণঘাটে কেন সেদিন দলের বিধায়ক কোন রাজকার্য করতে গিয়েছিলেন? অভয়ার বিষয়ে প্রাসঙ্গিক এমন প্রশ্নের তালিকা অনেক অনেক বড়। কিন্তু এসবের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আন্দোলনকারীদের তৎপরতার পরিসর ঠিক ততটাই কিন্তু ছোট। অবাক তো হতেই হয় এমনতর কারবারে।

আন্দোলনকারীরা আসলে কাঁদের অপসারণ চাইছেন আদতে? কে তাঁরা? স্বাস্থ্য দফতর ও পুলিশ প্রশাসনের কিছু আমলা, এই তো? কি করেছেন তাঁরা? তাঁরা কিভাবেই বা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারলো? তাঁদের ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের শীর্ষ স্থানের সবুজ সংকেত ছাড়া এভাবে লিপ্ত হতে পারবেন? আন্দোলনকারীদের চোখে যাঁরা চক্ষুশূল তাঁরা যে আসলে পুতুল নাচের পাপেট মাত্র। কিন্তু প্রকৃত পুতুল নাচের কারিগর প্রসঙ্গে স্পিকটি নট কেন? ঠিক এই পয়েন্টে এতো ঔদার্য আপোষের আড়াআড়ি ভাব যথেষ্ট প্রকট। আন্দোলনকারীরা কি মূর্খ? তাঁরা কি এই শাসককে এহেন শাসন জাগলারি রসায়ন জানেন না? নাকি সব জেনেবুঝে ন্যাকামি করছেন? তবে কেন প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের পদত্যাগ দাবি থেকে বিরত থাকছেন? কিসের উদ্দেশ্যে? উদ্দেশ্য কি এটাই যে আবালবৃদ্ধবনিতা বঙ্গবাসীর সুতীব্র ভাবাবেগ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নির্দিষ্ট সুপ্ত ছকে আড়াল করার একটা সুক্ষ্ম পরিকল্পনা! ভাবুন তো চাকরি প্রার্থীদের অবস্থানটা, ডিএ দাবীরতদের আন্দোলনের কথা। কই তাঁদের দাবি সনদ নিয়ে তো কেউ কলকাতা পুলিশের প্রহরায় বাসে চেপে মুখ্যমন্ত্রীর সকাশে যেতে পারেননি! কই তাঁদের দাবি মেনে কোনও আমলাকে তো কখনও বদলি করা হয়নি! তাঁদের দাবি যে কত কত মাস ছাড়িয়ে কত বছরের সেটাই তো মানুষের ভুলতে বসার জোগাড়। তাঁদের দাবি কি অনায্য ছিল? অথচ সব ইস্যু ধুয়ে মুছে সাফ বর্তমানের এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো এটাই চাইছিলেন অন্তঃকরণে। বিগত তেরো বছরের শাসনকালে আন্দোলনকারীদের জন্য মুখ্যমন্ত্রী এতো দরাজ কখনও হয়েছেন এমনটা দেখেছেন কি? অথচ জামাই আদর করে জুনিয়র ডাক্তারদের বাস ভ্রমণের সুযোগ করে দিলেন তাঁর বাসভবণ পর্যন্ত। আর নানান লোক দেখানো দুপক্ষের জেদাজেদির সার্কাস দেখিয়ে এই আন্দোলনকে অন্ততঃ পুজোর আগে পর্যন্ত ক্ষাণিকটা হলেও জিইয়ে রাখার ফন্দিটাও বেশ কিন্তু জমাটি। অনেকেরই আশঙ্কা, দুই তরফের গোপন শর্ত হলো, আমি তোমাদের কিছু দাবি মেনে তোমার অ্যাডভান্টেজ পাইয়ে দেব প্রচারে ফোকাসে হিরোর বহুরূপীতে। অনেকটা সুমিষ্ট ললিপপ চুষিয়ে দেবার মতো। বিনিময়ে তোমরা মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাইবে না। অভয়া প্রকৃত প্রসঙ্গে চরম দাবি দাওয়া একদম করবে না। তবে লোক দেখানো একটু হাল্কা আবদার অবশ্যই করবে তিলোত্তমার বিচার চেয়ে। আর বাকি কিছু খুচরো আমলার অপসারণ তোমরা জোড় কদমে চাইবে। ওরা তো এমনিতেই বলির পাঁঠা। আর কাজের সুরক্ষা নিয়ে সুর চড়াতেই পারো। কারণ এসব হলো লংটার্ম কন্টেনিয়াস প্রসেস। কিছুদিন বাদে সবাই এসব ভুলেও যাবে। তাই না? আপনারা বলছেন, আপনাদের আন্দোলন নাকি পুরোপুরি অরাজনৈতিক। খুব ভালো কথা। বিজেপির জনা কয়েক নেতাকে গো ব্যাক বলেছেন। সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু সিপিএম নেতারা আপনাদের কাছে এলে গো ব্যাক বলতে ভুলে গেলেন কেন? উল্টে সঙ্গত দিলেন কেন? এতো স্পষ্ট দ্বিচারিতা। নাকি বিজেপির দফা এক দাবি এক মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ, স্লোগান ভোঁতা করার আসল লক্ষ্যে কৌশলে অভয়ার ছবি সামনে রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোপন ছায়া রূপে ছলনার ড্যামি আন্দোলন করছেন। ঠিক যেমনটি রামের পাদুকা সামনে রেখে ভরত রাজ্যপাট পরিচালনা করেছিলেন। মিডিয়ার বুমের সামনে তো লাগাতার ডায়লগ মারছেন, আর যাতে দ্বিতীয় অভয়াকান্ড আগামীতে না হয়, তার জন্য এই আন্দোলন? ছকবাজি বাদ দিয়ে, ডিফ্যাক্টোর ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়ে, প্রকৃত অরাজনৈতিক আন্দোলনের শরিক হয়ে, আগামীদিনের সুবিধাবাদীর রূপকারের ধান্দা ছেড়ে, অভাগিনীর মৃত আত্মাকে সামান্যতম মর্যাদা দিয়ে তাঁর ধর্ষক ও খুনি সহ সব ষড়যন্ত্রকারীদের শাস্তির দাবিতে সর্বাগ্রে বিবেকের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হোন চরম সোচ্চারে। আর যে প্রশাসনের সৌজন্যে এই ষড়যন্ত্রকারীরা এতকাল প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে সেই প্রশাসনের পদত্যাগ সরাসরি দাবি করুন কোনও ভনিতা না করে। নচেৎ আপনাদের কপালে কলার খোসাটিও যে জুটবে না এটা হলফ করে বলতে পারি। কারণ আপনাদের উল্টো দিকে রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনৈতিক শকুনির মতো তিনি দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তুখোড় বুদ্ধিধর। দড় কষাকষির পাশার চালে তার সঙ্গে খেলতে গিয়ে দেখবেন আবার অচিরেই ভিলেন না বনে যান খামোকা। শুধু একটা আপ্তবাক্য মনে রাখবেন, গোপন আপোষের সঙ্গে রফা করে বা ছলনা করে কখনই নয়, কোনও স্বৈরাচারী শাসককে ঝোঁকানো কোনভাবেই সম্ভব নয়। এরজন্য আন্তরিক ভাবে প্রয়োজন আরও একটা সঙ্ঘবদ্ধ প্রবল দৃষ্টান্তহীন শৃংখলা মুক্ত সুতীব্র গণপ্রতিঘাত। এটাই বৈশ্বিক দস্তুর। অন্যদিকে অভয়ার বাবা মা কিন্তু এখনও আপনাদের দিকেই তাকিয়ে আছেন একবুক আশা নিয়ে, দয়া করে এটুকু অন্তত স্মরণে রাখবেন, এই আশা তো রাখবোই এক সহনাগরিক হিসেবে।

(www.theoffnews.com RGKAR rape agitation)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours