সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

রাজসূয় আলোচনার বিষয়বস্তু: "পশুসম্পদ পালন ও মৎস্য চাষ বিষয়ক কর্মসংস্থান এবং আয়বর্ধক আলোচনা" শীর্ষক সভা।

আয়োজকের ভূমিকায়: মার্চেন্ট চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি নামক শতবর্ষ অতিক্রান্ত বণিকসভা।

সভাক্ষেত্র: কলকাতার ঐতিহ্যময় দ্য ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল।

ক্ষণকাল: মঙ্গলবারের বারবেলা বলতে অবশ্যই মধ্যাহ্ন লগ্ন।

আপাতত দৃষ্টিতে এই হলো আলোচনার আতসে সর্বাত্মক উঠে আসার নির্যাস। তাহলে বিবরণের বিস্তারিত ফর্দটাই বা কেমন তা নিয়ে কৌতুহল থাকতেই পারে। নির্ধারিত সময়ের কিছু পরেই ডায়াসে অলঙ্কিত করে বসলেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী বিপ্লব রায়চৌধুরী ও স্বপন দেবনাথ। প্রথমজন মৎস্য চাষ মন্ত্রকের মন্ত্রী। অপরজন মন্ত্রীত্ব সামলান প্রাণীসম্পদ দফতরের। যুগলের দুই পাশের আসনে বসলেন সংশ্লিষ্ট বণিকসভার কর্তাব্যক্তিরা। সঙ্গে আসীন ছিলেন এক মৎস্য রপ্তানীকারক।

যথারীতি বণিকসভার পক্ষে ভাষণ দেন নমিত বাজোরিয়া, অমিত কুমার সারাওগি ও মদনমোহন মাইতি। পর্যায়ক্রমে তাঁদের বক্তব্যের সারাংশ এটাই, প্রাণী সম্পদজাত উৎপাদনের হার বর্তমান ভারতের ধান উৎপাদনের মাত্রাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। দেশের খাদ্য স্বনির্ভরতা ও গ্রামীণ অর্থনীতির এক উল্লেখযোগ্য সূচক হলো প্রাণীসম্পদ প্রক্রিয়াকরণ। সম্প্রতি দুধ, ডিম, মাছ ও মাংস উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ অন্যান্য রাজ্য থেকে একেবারে প্রথম সারিতে উঠে এসেছে। তাঁরা জানান, চীনের পর ভারত হলো বিশ্বের দ্বিতীয় দেশ যারা সর্বোচ্চ পরিমাণ মাছ সারা পৃথিবীতে সরবরাহ করে থাকে। দুনিয়ার ৮ শতাংশ মাছ ভারত রপ্তানি করে বিভিন্ন দেশে। আর এখানেই এই রাজ্যে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ২০.৪৫ লক্ষ মাছ উৎপাদিত হয়েছে। সঙ্গে মৎস্যচারা উৎপন্নের সংখ্যা ২ হাজার ৭০০ কোটি। শুধু এই রাজ্য থেকেই ৫,০০০ কোটি টাকা মূল্যের ১.১৭ লক্ষ টন মাছ রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে। তাঁদের আরও বক্তব্য, উত্তরপ্রদেশের পর ডিম উৎপাদনে এই রাজ্য সারা দেশের মধ্যে এখন দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে।

বণিকসভার তরফে এমনতর মন্তব্যকে সরাসরি সমর্থন করে রাজ্যের মন্ত্রী বিপ্লব রায়চৌধুরী বলেন, "যেখানে চাকরির সুযোগ ক্রমশঃ জটিল হচ্ছে সেখানে বিকল্প কর্মসংস্থানের পরিসর নিয়ে সবাইকেই এগোতে হবে। স্বনির্ভরতার প্রশ্নে আমাদের রাজ্য সরকার এই বিষয়ে যথেষ্ট সংবেদনশীল। আর এমন পরিস্থিতিতে মৎস্য চাষ হলো কর্মসংস্থানের এক নির্ভরযোগ্য ভিত্তি।" তাঁর সংযোজন, "রাজ্য সরকারের মৎস্য মন্ত্রক দার্জিলিং বাদে সমগ্র রাজ্যের ৩৩৫ টি ব্লকে ৪০,০০০ জনকে বিজ্ঞান সম্মত মৎস্য চাষের প্রশিক্ষণ ইতিমধ্যেই দিয়েছে। মৎস্য উৎপাদন সহায়ক উন্নতমানের ল্যাবোরেটরি তৈরি হয়েছে জুনপুটে।"

মূলতঃ বিপ্লববাবু সহ বণিকসভার কুশীলবেরা যখন উচ্চগ্রামে রাজ্যের প্রাণীসম্পদ ও মৎস্য চাষের সাফল্যের একতরফা দামামা বাজিয়ে যাচ্ছিলেন তখন সেই আলোচনার ছন্দের আচমকাই তাল কেটে বসলেন রাজ্যেরই এক মৎস্য রপ্তানিকারক। বিপ্লববাবুর নিজস্ব জেলা পূর্ব মেদিনীপুরের বাসিন্দা ওই মৎস্য রপ্তানিকারকের নাম মির মামরেজ আলী। রাজ্যের প্রাণী বিকাশের প্রসঙ্গে উপস্থিত সব বক্তারা ক্রমাগত সাফল্যের কাহারবা বাজালে কি হবে, তিনি তো হঠাৎই সবাইকে চমকে দিয়ে দাদরার বোল তুলে বসলেন। তিনি বলেন, "আমি শুরুতে খুব ছোট অবস্থায় মাছের খুচরো ব্যবসা করতাম। পরে ধীরে ধীরে ব্যবসা লাভজনক হতে থাকে। মাছের রপ্তানি শুরু করি একসময়ে। বিগত অর্থবছরে ৭০০ কোটি টাকা লেনদেন করেছি। ৩,০০০ জনের আয়ের সংস্থান করেছি। অথচ চলতি বছরে ব্যবসার হাল দুর্ভাগ্যজনক ভাবে নিম্নমুখী।" আক্ষেপের সুরে বলেন, "রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন হারে ধার্য করের অনুপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। তার উপর গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো রপ্তানিযোগ্য মাছের মূল্য থেকে সম্প্রতি স্থানীয় বাজারজাত সংগৃহীত মাছের মূল্য অস্বাভাবিক পর্যায়ে বেড়ে গিয়েছে। তাই আমার ব্যবসার লাভের ইমারত এখন ভেঙ্গে পরার মুখে। তবে আশা ছাড়িনি।"

আলোচনা সভায় রাজ্যের মৎস্য রপ্তানিতে এমন বিপরীতমুখী হালের ফিরিস্তি শুনে উপস্থিত শ্রোতারা যে স্তম্ভিত হয়েছেন তা কিন্তু বিলক্ষণ উপলব্ধি করেছিলেন রাজ্যের অপর পোড় খাওয়া মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। তড়িঘড়ি পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি পোডিয়ামের সামনে এসে ওই মৎস্য রপ্তানিকারকের উদ্দেশ্যে বলেন, "ব্যবসায় তো একটু আধটু ওঠানামা থাকেই। এই ঝুঁকি তো নিতেই হয় সব ব্যবসায়ীকে। তবে আপনি চিন্তা করবেন না। রাজ্য সরকার আপনার পাশে রয়েছে। আমরা সর্বোতভাবে আপনাকে সাহায্য করবো।" এরপরেই তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একটি উৎসাহ ব্যঞ্জক পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, "যাঁরা পশুপালনের জন্য খামার বানিয়ে উদ্যোগী হতে চান তাঁদের জন্য রাজ্য সরকার সহজ শর্তে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। সঙ্গে জমির মূল্যেও বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করা হবে।"

পরিশেষে এটা বলতেই হয় যে মন্ত্রীদের অজস্র সহস্র সদর্থক আশাব্যঞ্জক আর্থিক অগ্রগতির কথা শোনা গেলেও আলোচনাচক্রে কিন্তু সেই মৎস্য রপ্তানির অশনিসংকেত বিষয়ক দুধে চোনা পড়ার অধ্যায়টা শেষ অব্দি থেকেই গেল।

(www.theoffnews.com - seminar)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours