কৃষ্ণা গুহ রায়, লেখিকা ও সমাজকর্মী, কলকাতা:

জোড়াসাঁকো রবীন্দ্র ভারতীর প্রদর্শন শালার  প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ  এবং চিত্রশিল্পী সমর ভৌমিক  তার একমাত্র কন্যাটিকে যখন চৌদ্দ বছর বয়সে হারালেন তখন ছবি আঁকায় আরও মনসংযোগ বাড়িয়েছিলেন৷ আমাকে যেদিন তিনি প্রথম দেখেন   কন্যা হারা পিতার বুকে জেগে উঠেছিল অপার পিতৃস্নেহ৷ ১৯৫৫ সালে তদানীন্তন সোভিয়েত রাশিয়ায় ভারত সরকারের যুব শিল্পী হিসাবে  নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে যখন তিনি মস্কো গিয়ে চিত্র কর্মশালায় যোগ দেন তখন তিনি লক্ষ্য করেছিলেন  অধিকাংশ যুবক-যুবতী শিল্পীর মধ্যে একটাই মূল কথা ব্যক্ত হয়েছে তা হল বিশ্বজনীনতা এবং বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব। যা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। পরবর্তীকালে ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সূত্র ধরে তিনি যখন বিশ্ব ভ্রমণ করেছিলেন, বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত শিল্পী ও লেখকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উনি লক্ষ্য করেছিলেন বিরোধিতা দিয়ে সমস্ত কাজ ভণ্ডুল করার চেষ্টা এইসব জায়গায় নেই। বরং চিন্তা ও কর্মের মিলনের চেষ্টা সকলের মধ্যে একান্ত ভাবে রয়েছে৷ এর ফলে ঐক্যমতে  পৌঁছবার একটা সর্বাত্মক চেষ্টা  লক্ষ্য করা যায়৷ উল্লেখ্য রবীন্দ্রনাথও মতান্তরে বিশ্বাস করতেন মনান্তরে নয়৷

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য শ্রদ্ধাভাজন মানুষটির মুখেই শুনেছিলাম হাঙ্গেরির কথা৷ হাঙ্গেরি দেশটি মূলত  গ্রিক ও রোমান সভ্যতা এবং ভারতীয় সংস্কৃতির মিলনস্থল ৷ হুন এবং ম্যাকগ্রেরিয়ানদের আদি বাসস্থান। অতি প্রাচীনকাল থেকে এদের সভ্যতা  এবং সংস্কৃতি প্রাচীন চিন্তার মিশ্রণে চলছে৷ দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে মোটা তাঁরে বাঁধানো সরু পথে অজস্র ফুলের গাছ। সেগুলো অনাদি অনন্তকাল ধরে রূপ ও সৌগন্ধ বিতরণ করে চলেছে।

এই হাঙ্গেরিতে বালাতান ফ্যুরাদের বৃক্ষ ছায়ায় রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ অবস্থায় থেকেও তাঁর "লেখন" সমাপন করেছিলেন৷ যেদিন এই বইয়ের কাজ শেষ হলো, সেদিনই তিনি সুস্থ হয়ে লেকের পাড়ে অনেকটা ঘুরে বেড়িয়েছিলেন৷ আর একটি পপলার গাছের চারা পুঁতেছিলেন ৷ 

সেই বৃক্ষের চারা ডালপালা ছাড়িয়ে এখন অনেকটাই বড়৷ রামকিঙ্করের গড়া রবীন্দ্রনাথের মূর্তি সেই গাছের তলায় স্থাপিত যা দ্রষ্টব্যও বটে৷ 

ঐতরেয় ব্রাহ্মণে আছে, "আত্মসংস্কৃতি বার্ব শিল্পানী", অর্থাৎ শিল্পই আত্ম সংস্কৃতিকে বিকশিত করে। একথা অনস্বীকার্য যে কোনও শিল্পের প্রতি রবীন্দ্রনাথের অগাধ পাণ্ডিত্য তার আত্মার সংস্কৃতিকে বিকশিত করেছিল৷ 

একজন রাজার কথা শুনেছিলাম শৈশবে৷ তিনি আসতেন একা একা বৈশাখে৷ গানে, কবিতায়, নৃত্যে, নাটকে ফুলের সভায়৷ শুনেছি বিশাল তাঁর চকমিলান বাড়ি৷ তাঁর মনোজগতে ছিল না পরিখা কোনও, ছি লনা প্রহরা৷ 

সে খোলা জানালার ধারে বসে কখনও অমল হয়ে নিত্য পথচারীদের আনাগোনা প্রত্যক্ষ করতো, কখনও তারাপদ হয়ে আতিথেয়তার আরাম বর্জন করে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল প্রকৃতির উন্মুক্ত ঠিকানায়৷ আবার কখনও বা সেই রাজাই বীরপুরুষ হয়ে উন্মুক্ত তরবারী হাতে ভয়ঙ্কর দস্যুদের হাত থেকে মাকে রক্ষা করতে দৃঢ়সঙ্কল্প৷ 

শিলাইদহের প্রজারা বুঝেছিল সেই রাজার স্নেহচ্ছায়া৷ দেশ, কালের গন্ডী ছাড়িয়ে তিনি যে তখন সবার হৃদয়ের রাজা৷ বিশ্বজয়ের মুকুট মাথায় পরেও নিরহঙ্কারী রাজাই যে একমাত্র বলতে পারেন, "এ মনিহার আমায় নাহি সাজে" 

ভানুসিংহের হাতে খড়ি, মাটি, শ্রীরাধার ছবি ঝুরঝুর। পাখোয়াজে জমজমাট গানের আসর ভেঙ্গে, শূন্য ভিটে, রিক্ত তালগাছের মাথায় ভাঙা জীবনের গান, কাক ডেকে যায়, হু হু বাতাসের শব্দে শুনি বাস্তুসাপের গাজন৷ মেহের আলীর মতন চিৎকার করে উঠি — "সব ঝুট হ্যায়" ৷ 

(www.theoffnews.com - Rabindranath Tagore)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours