পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

কাঁচের গ্লাসে পাতা দই। সেই দই দিয়ে চিড়ে মেখে দিত মা। সেই দই চিড়ে খেয়ে রওনা দিতাম সক্কাল সক্কাল স্কুলে। গরম এলেই এটা আমার কাছে ছিল চেনা ছবি। গরমের ছুটি পড়ার আগে বা পরে বেশ কিছুদিন আমাদের ক্লাস হত সকাল বেলায়। কোনওদিন কোনও অসুবিধে তো হয়নি। আচ্ছা এখন সকালে স্কুল কেন করা যায় না? অনন্তকাল গরমের অজুহাতে ছুটি না দিয়ে একটু সকাল সকাল যদি স্কুল করা যেত তাহলে তো ভালই হত? না, এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই, এ রাজ্যে কার জানা আছে তাও আমার জানা নেই। গ্রামের দিকে অনেক স্কুল যেগুলি আম কাঁঠাল জামরুলের ছায়ায় বসে, সেখানে সকাল তো বেশ মনোরম। সেখানে কেন সকালে স্কুল করা যায় না? 

বীরভূমে সাংবাদিক থাকাকালীন দেখেছি বিশ্বভারতীর প্রায় সব অনুষ্ঠান শুরু হত ভোর বেলায়। খুব বিরক্ত হতাম, সেই সিউড়ী থেকে অত ভোরে যাওয়া। এক অধ্যাপক আমায় বুঝিয়েছিলেন তার গুঢ় কারণ। আসলে গরমের দেশ বীরভূম। দিনের বেলায় খুবই গরম পড়ে সেখানে। তাই অধিকাংশ ক্লাস (বিশেষ করে পাঠভবনের) যেহেতু গাছতলায় খোলা পরিবেশে হয় সেজন্য সকাল সকাল করে নেওয়ায় হয়। ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষক কারোরই তেমন অসুবিধে হয় না। শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের শুভারম্ভও তাই ভোরের শান্তিপূর্ণ শীতল পরিবেশে হয়ে থাকে। 

এই সময় গরম একটু খামখেয়ালী থাকে। কখনও বাড়ে, কখনও বা হঠাৎ করেই অনেকটা কমে যায়। এই তো কদিন আগেই গরম এক লাফে অনেকটা কমে গিয়েছিল। আবার একটু বাড়ছে। কিন্তু আমরা তো বহুদিন আগে থেকেই ছুটি ঘোষণা করে বসে আছি। তাই গরম কমে গেলেও স্কুল খোলা যাবে না। একবার মুখ থেকে কথা (পড়ুন ছুটির ঘোষণা) যখন বেরিয়েই গেছে তখন রাজ্যে বরফ পড়লেও গরমের ছুটি বহাল থাকবে। আছেও তাই। 

এ এক অদ্ভুত সময়। যেখানে সামান্য গরমের ছুটির কথাও ঘোষণা করতে হয় মুখ্যমন্ত্রীকে। শিক্ষামন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলে তিনিও মুখ্যমন্ত্রীকেই দেখিয়ে দেন। অর্থাৎ একজন মানুষ, যাকে প্রকারান্তরে সব কটি মন্ত্রকই দেখতে হয়, তাদের হয়ে ঘোষণা করতে হয়, তার মাথা গরম থাকা স্বাভাবিক। সেই কারনে গরমের ছুটিও বেড়ে চলাটাই স্বাভাবিক। ছুটি ছাড়া কিভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব, কি ভাবে, কোন সময় স্কুল খোলা রাখা যেতে পারে, এ ব্যাপারে খুব একটা ভাবনা চিন্তা আছে বলে তো মনে হয় না। 

আমার অসংখ্য বন্ধু বান্ধব পরিচিত আত্মীয় পরিজন এমনকি ভাই বোনও শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। তাদের অধিকাংশের সঙ্গেই খোলাখুলি কথা হয়েছে। প্রায় সকলেই এই ছুটির বিপক্ষে। তাদের অনেকেরই বক্তব্য এই সরকারী স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই এমন পরিবার থেকে আসে যেখানে পড়াশোনার পরিবেশ পাওয়াটাই মুশকিল। সেখানে স্কুলে এলে অন্তত নিয়মিত পড়াশোনাটা তাদের হয়। কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকা মানেই একটা বড় অংশের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ধারাবাহিকতায় ইতি। 

আমাদের পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ড, বিহার বা ওড়িশায় কিন্তু স্কুল খোলা। সেখানে নিয়মিত ক্লাস চলছে এই গরমেও। তাদের যদি খুব অসুবিধে না হয়, তাহলে আমাদের কেন? এর আগে করোনার সময়েও দেখেছি পাশের রাজ্যে যখন শিক্ষার্থীরা বইখাতা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে তখন আমাদের রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরা অনন্ত ছুটি উপভোগ করেছে। ওসব রাজ্যের সরকার কি তাহলে শিশুদের শত্রু? ওখানকার বাব মায়েরা কি তাদের ছেলেমেয়েদের একেবারেই ভালবাসেন না? ওখানকার শিক্ষক শিক্ষিকারাই কি শুধুমাত্র ভালবাসেন তাদের ছাত্রছাত্রীদের? আমাদের রাজ্য দেখে তো তাই মনে হয়। 

আমাদের রাজ্যে এই সময় অধিকাংশ বেসরকারি স্কুলই খোলা। সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই ক্লাস পরীক্ষা সবই চলছে। হচ্ছে বুদ্ধ জয়ন্তী, রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনও। তারা সকলেই সকাল সকাল স্কুলে যায়, পড়াশোনা করে চলে আসে। কিন্তু পাশেই থাকা সরকারী স্কুলগুলিতে একই সময়ে অসীম শূন্যতা। আচ্ছা এবার একটু তর্ক উসকে দিয়ে বলি এই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলিতে পড়ে মূলত একটু পয়সাওয়ালা বা স্বচ্ছল ঘরের ছেলেমেয়েরা। তারা স্বাভাবিক ভাবেই একটু আদর বা প্রশ্রয়ে প্রাচুর্যেই মানুষ হয়। সেই শিশুরা যদি এই গরমে দিব্যি স্কুলে যেতে পারে তাহলে তথাকথিত খেটে খাওয়া গ্রামের পরিশ্রমী পরিবারের ছেলেমেয়েরা কেন এই সময়ে স্কুলে যেতে পারবে না। আমি জানি আমার এই কথায় বিতর্ক হতেই পারে। আদুরে পরিশ্রমীর সংজ্ঞা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন। কিন্তু আমি যা বোঝাতে চেয়েছি সেটা নিশ্চয় বুঝিয়ে দিতে পেরেছি সকলকেই। 

আমাদের নিরব থাকা মানে আমাদের ছেলেমেয়েদের শৈশবগুলি ক্রমশ চুরি হয়ে যাওয়া। আমাদের কিছু না বলা মানেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষা নিয়ে ক্রমাগত আপোষ করে যাওয়া। আমাদের মুখে কুলুপ মানেই আমাদের শিশুটির আগামী দিনে হাহাকারের মাত্রা একটু একটু করে বেড়ে যাওয়া। স্কুল বন্ধ করে এটাই প্রমাণ করেছে সরকার তারা জনদরদী। কিন্তু স্কুল খোলা রেখে বা খোলা রাখার নানা উপায় খোঁজার চেষ্টা করে এটা প্রমাণ করেনি তারা আগামীর কথাও ভাবে। ভোট রাজনীতিতে আমরা এখন আপাদমস্তক ডুবে, তাই আপনার আমার একটাই পরিচয় ভোটার। নাগরিক নন আপনি, শুধুই ভোটার। শিশু ভোট দেয় না, তাই ওদের তেমন দরকার নেই। শেখারও তেমন দরকার নেই, শিখলেই নানা প্রশ্ন, যুক্তি, ন্যায় অন্যায় নিয়ে কথা বাড়াবে। তার চাইতে ছুটি দাও ছুটি। আরও ছুটি, আরও ছুটি। কে যেন বলেছিলেন “লেখাপড়া করে যে গাড়ি চাপা পড়ে সে”, “জানার কোনও শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই।”

(www.theoffnews.com - long school summer vacation West Bengal)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours