কাজী নূর, কবি, সাহিত্যিক ও ফিচার রাইটার, বাংলাদেশ:
আজ ১০ এপ্রিল। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের অন্যতম সহযোগী অগ্নিপুরুষ বীর বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর প্রয়ান দিবস। ২০১৩ সালে ইতিহাসের এই দিনে কলকাতার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, মহামারী, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, ভাষা আন্দোলন, গণ অভ্যুত্থান, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ সহ বহু ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন মহান আর্দশের এই গুণী মানুষটি।
কিংবদন্তী বিনোদ বিহারী চৌধুরী ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কামিনী কুমার চৌধুরী ছিলেন পেশায় আইনজীবী এবং মা রামা রাণী চৌধুরী ছিলেন গৃহিণী। তার স্ত্রীর নাম বিভা দেবী চৌধুরী। চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া বোর্ড স্কুলে তার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু৷ সেখান থেকে তিনি ফটিকছড়ি করোনেশন উচ্চ বিদ্যালয়, বোয়ালখালির পি. সি. সেন সারোয়ারতলি উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগাম কলেজে পড়াশোন করেন। ১৯২৯ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তাকে বৃত্তি প্রদান করা হয়৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৩৪ এবং ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ রাজের রাজপুটনার ডিউলি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম শ্রেণীতে আই.এ. এবং বি.এ. পাস করেন।
বিনোদ বিহারী চৌধুরী ১৯৩০ সালে কংগ্রেস চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সহ- সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস নির্বাহী কমিটির সদস্য থাকার পাশাপাশি ১৯৪৬ সালে কংগ্রেস চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ৩৭ বছর বয়সে পশ্চিম পাকিস্তান কংগ্রেসের সদস্য হন তিনি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করলে রাজনীতি থেকে অবসর নেন বিনোদ বিহারী চৌধুরী। এরপর ১৯৩৯ সালে তিনি একটি দৈনিক পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম আদালতে আইনজীবী হিসেবে অনুশীলন শুরু করেন তিনি। অনেকবার পেশা বদলের পর শেষে বিনোদ বিহারী চৌধুরী শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।
বিপ্লবী দলে নাম লেখানোর অল্প দিনের মধ্যেই বিনোদ বিহারী চৌধুরী মাস্টারদা সূর্যসেনের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছিলেন। তাই ১৯৩০ সালে ঐতিহাসিক অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সময়ে মাস্টারদা সূর্যসেনের অন্যতম সহযোগী হতে পেরেছিলেন বিনোদ বিহারী চৌধুরী। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্রগ্রামকে তিনদিনের জন্য স্বাধীন করেছিলেন তিনি। টেলিগ্রাফ অফিস ধ্বংস করা, অক্সিলারি ফোর্সের অস্ত্রশস্ত্র লুট করেছেন। দামপাড়া পুলিশ লাইন, এখানে অস্ত্রের গুদাম ছিল, সেটাও তিনি ও দলের সদস্যরা মিলে লুট করেন। এ দলে প্রধান মাস্টারদা সূর্যসেন সহ ছিলেন হিমাংশু সেন, অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ ও আনন্দ গুপ্ত। ১৯৩০সালের এ ঘটনার পর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন জঙ্গি রূপ ধারণ করে। ভয়ংকর সেই দিনে এসব বিপ্লবীরা দুঃসাহসিক বহু কর্মকান্ডে ব্যর্থ হয়নি। চট্টগ্রাম সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত ছিল চার দিন। এই কয়েক দিনে ব্রিটিশ সৈন্যরা শক্তি সঞ্চয় করে বিপ্লবী দলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত বিনোদ বিহারীরাও বীর বিক্রমে জালালাবাদ পাহাড়ে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন। জালালাবাদ যুদ্ধ ছিল বিনোদ বিহারী চৌধুরীর প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ। গলায় গুলিবিদ্ধ হয়েও লড়াই থামেনি তার। চোখের সামনে সেদিন তিনি দেখেছিলেন ১২ জন বীর সহযোদ্ধার মৃত্যু।
এমন বিপ্লবীরা ছিলেন বলেই এই ভুখন্ড হতে ব্রিটিশরা চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। যুগযুগান্তর কীর্তিমান বিনোদ বিহারী জেগে আছেন, থাকবেন মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায়। সংগ্রামী অগ্নিপুরুষেরা শুধু দেহ ত্যাগ করেন। তারা অমর।তাদের মৃত্যু হয়না। তাদের কীর্তিমান অধ্যায় চিরঞ্জীব বাঙালির ইতিহাসে। এই সব বীরেরা বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে আমাদের প্রেরনা হয়ে।
(www.theoffnews.com - freedom fighter Binod Bihari Chowdhury Bangladesh)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours