পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

দৃশ্য ১ঃ প্রবল আওয়াজে হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘুম ঘুম চোখে হাতড়ে মোবাইলটা নিয়ে দেখি রাত একটা বাজে। ঘোর কাটলে বুঝলাম ডাল লেকের উপরে ভাসমান হাউজবোটের নরম বিছানায় শুয়ে আছি। গতকাল খুব ঘোরাঘুরির কারনে দশটা নাগাদ শুতে না শুতেই ঘুম চলে এসেছিল। কিন্তু অনতিদূরে মাইকে গান বাজনার প্রবল আওয়াজে সেই ঘুমের দফারফা। বোটের বারান্দায় বেরিয়ে দেখলাম সামনেই কোনও একটা জায়গা থেকে ঐ শব্দ ছুটে আসছে। সারা রাত ধরে চলল তার স্বরে ওই চিৎকার, গান। ঘুমই এলো না তার পর থেকে আর। ভোরে ওই শব্দের সঙ্গে শুরু হল সামনের পাহাড়ের মন্দির থেকে সকালের প্রার্থনা। না, সেই প্রার্থনা বা ভজনও অ-মাইক ছিল না। সকালে শুনলাম সারারাত ধরে বিয়ের আসর উপলক্ষে ওই গান। 

দৃশ্য ২ঃ কলকাতার উপকণ্ঠে আমার ফ্ল্যাট। সন্ধ্যে থেকেই ছট পুজোর জমজমাট আবহ। চার দিকে বাজি ফাটছে, উল্লাস। একে একে একটি দল জলাশয়ের দিকে চলেছে, সঙ্গে চলেছে ডিজে বা প্রবল বাজনা। রাস্তার ধারেই বাড়ি, প্রায় সারা রাত কাটিয়ে সকাল পর্যন্ত চলল শোভাযাত্রা। রাতভর আমরা ছটফট করলাম এই ছটের কারনে। একই অভিজ্ঞতা এক সপ্তাহ আগে কালীপুজোর আগের এবং পরের রাতেও। সারা রাত ধরে চলল ঠাকুর মণ্ডপে নিয়ে যাওয়ার উল্লাস। রাতদুপুরেও পাল্লা দিয়ে চলল ডিজে বা অদ্ভুত ওই বাজনা। ঠাকুর বিসর্জনের সময়েও ছবিটা বাদলায়নি। বলা বাহুল্য আমরা বিনিদ্র রাত কাটিয়েছি রাস্তার ধারে বাড়ি হওয়ার অপরাধে। 

দৃশ্য ৩ঃ বাঁকুড়ার বরদি পাহাড়ের কোলে একটি রিসর্টে রয়েছি আমরা। হালকা শীতের রাত, কাছেপিঠে গ্রাম না থাকায় এক নিস্তব্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশ। ছোট্ট পাহাড়ের কোলে শাল পলাশের জঙ্গল, সামনে কংসাবতীর বয়ে যাওয়ার মিহি শব্দ আর মাঝে মধ্যে অজানা পাখির ডাক। ভালই লাগছিল বেশ। হঠাৎই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে শুরু হয়ে গেল ডিজের ঢিপ ঢিপ আওয়াজ। নদীর ওপারের গ্রাম সেই শব্দের উৎস। কলকাতার হট্টগোল পিছনে ফেলে এসেছিলাম একটু নির্জনতার স্বাদ পেতে। সে স্বাদে নুন পড়ে গেল। সন্ধ্যে কাটিয়ে একটু রাত নামতে থামল ডিজে, আশ্বস্ত হলাম আমরা। এবার বোধহয় নিস্কৃতি মিলল, কিন্তু না, তার পরে তার চেয়েও জোরে শুরু হল কীর্তন। ভাবলাম রাত ১১টার পরে নিশ্চয় কমে যাবে। কিন্তু কোথায় কি? গোটা রাত ধরে উচ্চস্বরে চলল সেই কীর্তন। বরদির সেই নিরিবিলি সৌন্দর্য আমরা উপভোগই করতে পারলাম না সেই প্রবল শব্দের কারনে। 

উপরের তিনটি দৃশ্য তিন জায়গার, তিন ধরনের পরিবেশের। কিন্তু শব্দের কারনে জব্দ হওয়ার ছবিটা তিনটে ক্ষেত্রেই এক। আমাদের উৎসব আনন্দ, সব কিছুতেই শব্দের আধিক্য যেন আনন্দের মাত্রা বাড়ায়। বিয়ে বাড়ি, পিকনিকে গিয়ে দেখবেন ডিজের আওয়াজে প্রাণ ওষ্ঠাগত, অন্য পরিচিতদের সঙ্গে  কথা বলা বা শোনা কোনওটাই করা যায় না। অথচ সকলে ওই গান বা আওয়াজ যে খুব মন দিয়ে শুনছে তেমনটাও নয়। শুধু ওই দানবীয় আবহটা বজায় রাখা। ধর্মীয় যে কোনও অনুষ্ঠানে আগে মাইক বাঁধাটা আবশ্যক। সব ধর্মের এক অবস্থা। প্রত্যেকেই চাইছে তার চিৎকার পৌঁছে যাক সকলের কানে, সামনে থাকা সেই মানুষগুলি চান বা না চান। 

এ তো গেল উৎসবের একটা দিক। আরও একটা দিক আছে। রাজনৈতিক সভা সমাবেশ। নিজের কথা শোনানোর জন্য এ এক অতি নারকীয় পদ্ধতি আমাদের দেশে। যে কোনও রাজনৈতিক সভা বা সমাবেশে দূরদূরান্ত পর্যন্ত বাঁধা হয় মাইক বা লাউড স্পিকার। যতটা বেশি আওয়াজ দেওয়া সম্ভব তার চেয়েও বেশি মাত্রায় দেওয়া থাকে তা। তার চেয়েও বেশি আওয়াজে চিৎকার করে নিজের বক্তব্য পেশ করেন রাজনীতির কারবারিরা। এলাকায় অসুস্থ রোগী থাকেন, থাকে ছাত্রছাত্রীরা, থাকেন সুশীল নাগরিকেরাও। কিন্তু অসহায়, নিরুপায় তারা। শব্দের এই তাণ্ডবে বিপর্যস্ত নাগরিককে উদ্ধার করবার মত কেউ থাকেন না। 

সাধারণত ৫৫ থেকে ৬৫ ডেসিবেলে আমরা কথা বলি। তার চেয়ে জোরে কথা বললে আমাদেরই কানে লাগে। ১০০ ডেসিবেল আমাদের পক্ষে বিপদজনক। ১২০ ডেসিবেল আমাদের জন্য মারাত্মক। বাজার চলতি যে ডিজে বক্সগুলি বাজে তা অধিকাংশই ১০০ ডেসিবেলের উপরে থাকে। কখনও কখনও যা ১২০ ডেসিবেলও ছাড়িয়ে যায়। আমাদের জন্য অতি ক্ষতিকর এই শব্দদানবের হাত থেকে রেহাই নেই শহর গ্রাম কোথাও। উৎসব বা আনন্দের অপরিহার্য উপাদান হয়ে উঠেছে এই শব্দ শত্রু। 

কিছুদিন আগেই উত্তরবঙ্গে জল্পেশের শিবমন্দিরে যাওয়ার পথে চ্যাংরাবান্ধায় গাড়িতে ভয়াবহ  দুর্ঘটনা প্রাণ কেড়ে নেয় ১০ পুণ্যার্থীর। জানা যায়, ডিজে বাজিয়ে জেনারেটর নিয়ে ছুটছিল  পুণ্যার্থী বোঝাই সেই গাড়ি। শর্ট সার্কিটে ঘটে যায় ভয়ঙ্কর ঘটনা। উত্তরবঙ্গে এর পরে ধর্মীয় শোভাযাত্রায়  ডিজে নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকি দুর্গা পুজো কার্নিভালেও ডিজে বন্ধই রাখা হয়। একই নিয়ম লাগু হয় কলকাতার ক্ষেত্রেও। কিন্তু প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা থাকলেও লুকিয়ে চুরিয়ে অথবা প্রকাশ্যে এই শব্দ দানবের অত্যাচার অব্যাহত। আসলে অন্য মানুষকে বিরক্ত করে আনন্দ পাওয়ার স্বাভাবিক এক প্রবণতা আমাদের মধ্যে প্রবল। ধর্মীয় ছাপ থাকলে প্রশাসনও কিছুটা দূরে থাকে। তাই এই সুযোগে নিয়ম ভাঙাটা বা প্রকারান্তরে অন্যের প্রতি অত্যাচারটা কিছুটা সহজ হয়ে পড়ে। সেই সুযোগ নিতে পিছপা হয় না কোনও ধর্মের মানুষজনই।  

শুধু কি মানুষ? এই শব্দ দানবের অত্যাচারে প্রবল অস্বস্তিতে থাকে আমাদের আশপাশে থাকা পশুপাখিরাও। তাদের সঙ্গে কখনও প্রত্যক্ষ ভাবে কখনও বা পরোক্ষ ভাবে চলে এই নির্যাতন। লেজে পটকা বেঁধে ভয় দেখানো হোক বা কানের কাছে প্রবল শব্দের উৎপত্তি ঘটিয়ে ভয় দেখানো, আনন্দের অপর নাম এগুলিই। তারা প্রতিবাদ করতে পারে না, ভয়ে কুঁকড়ে থাকে, প্রতিবাদ তো করতে পারি না আমরাও। কেউ কেউ তার মাঝে গর্জে ওঠেন, কিন্তু তার সেই গর্জন চাপা পড়ে যায় সমাজের সংখ্যা গরিষ্ঠের উল্লাসে। দিনের শেষে কলমের মাধ্যমে আমারও তাই প্রতিবাদ থাকল এই শব্দের হাতে জব্দ মানুষ বা না-মানুষ সকলেরই পক্ষ থেকে।

(www.theoffnews.com - sound pollution)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours