কাজী নূর, কবি, সাহিত্যিক ও ফিচার রাইটার, বাংলাদেশ:

‘যখন শুনেছি আমি মৃত্যু আছে সূর্যেরও, অম্লান অগণন জ্যোতিষ্কের ভাগ্যলিপি মৃত্যু দিয়ে ঘেরা / তখনি হয়েছে মনে এ আকাশ রহস্যের ডেরা / তখনি হয়েছে মনে এ জীবন ক্ষণিকের গান।’

এমন অসংখ্য জনপ্রিয় এবং কালজয়ী কবিতা, গানের জনক বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের গর্বিত নবাব কবি ফররুখ আহমদ। ফররুখ আহমদ বাংলা সাহিত্যে মুসলিম জাগরণের কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত। যিনি তার সৃষ্টি সম্ভার দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সুসমৃদ্ধ করেছেন। শিল্প, শৈলী ও সৃষ্টিশীলতার গুণে আজও সাহিত্য প্রেমীদের কাছে ফররুখ আহমদের আবেদন অনস্বীকার্য। ফররুখ আহমদের লেখা গান আজও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে প্রজন্ম থেকে নতুন প্রজন্মকে।

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় এবং শ্রেষ্ঠ কবি ফররুখ আহমদের জন্ম হয় ১৯১৮ সালের ১০ জুন তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার শ্রীপুর থানার অন্তর্গত মাঝআইল গ্রামের সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারে। বাবা পুলিশ ইন্সপেক্টর খান সাহেব সৈয়দ হাতেম আলী এবং মাতা বেগম রওশন আখতারের দ্বিতীয় পুত্র ফররুখ আহমদ। বংশপরম্পরা শিক্ষিত পরিবার হিসেবে গ্রামে তাদের ব্যাপক সম্মান ও খ্যাতি ছিলো। ফররুখ আহমদের দাদা ছিলেন সরকারী চাকরিজীবী আর দাদী ছিলেন শিক্ষিত জমিদার পরিবারের কন্যা।

ফররুখ আহমদ বাংলা সাহিত্যের এক শক্তিমান ও অনন্য দিকপাল। গ্রামের পাঠশালাতেই যার শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি হয়। ফররুখ আহমদ পরবর্তীতে কলকাতার তালতলা মডেল এম ই স্কুলে ভর্তি হন। এরপর কলকাতার বিখ্যাত বালিগঞ্জ সরকারি হাইস্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে পান আরেক বিখ্যাত কবি গোলাম মোস্তফা'কে। কবিত্ব বিকাশে কবি গোলাম মোস্তফা ফররুখ আহমদকে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা দেন। ফররুখ আহমদ ১৯৩৭ সালে খুলনা জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৯ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ফররুখ আহমদ ১৯৩৯ সালে কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন বিষয়ে এবং পরবর্তীতে ১৯৪১ সালে কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সে ভর্তি হন। তবে নানাবিধ কারনে এখানেই  প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সমাপ্তি ঘটে ফররুখ আহমদের।

সর্ব নন্দিত কবি ফররুখ আহমদ কলকাতায় ১৯৪৩ সালে আইজি প্রিজন অফিস ও ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাই অফিসে কিছুকাল চাকুরি করেন। এরপর ১৯৪৫ সালে সাময়িকভাবে মাসিক 'মোহাম্মদী' সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহন করেন। সাংবাদিকতা, সাহিত্যচর্চা নিয়েই জীবনের অনেকটা সময় অতিবাহিত করেন তিনি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের কিছুকাল পরে কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন ফররুখ আহমদ। এরপর ঢাকা বেতারে স্থায়ী চাকুরি নেন। ঢাকা বেতারে 'স্টাফ আর্টিস্ট' হিসেবে যোগদান করেন ফররুখ আহমদ। বেতারে 'ছোটদের খেলাঘর' নামে একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন তিনি।

ফররুখ আহমদ কিশোর বয়স থেকে কবিতা লিখলেও ১৯৪৪ সালে ২৬ বছর বয়সে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'সাত সাগরের মাঝি' প্রকাশিত হয়। ফররুখ আহমদ ছিলেন একজন ভাষা সৈনিক। ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তার মধুর চেয়েও মধুর যে ভাই আমার দেশের ভাষা' গানটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ভাষা আন্দোলন চলাকালীন সময় থেকেই তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জোরদার ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই কবি ফররুখ আহমদ মাসিক সওগাতের (সেপ্টেম্বর - অক্টোবর ১৯৪৭) সংখ্যায় পাকিস্তান: রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য নিবন্ধে লেখেন, "গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে পর্যন্ত যারা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে চান তাদের উদ্দেশ্য অসৎ। পূর্ব পাকিস্তানের সকল অধিবাসীর সঙ্গে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি"।

কবি ফররুখ আহমদকে কেউ ইসলামী রেনেসাঁর কবি' কেউ ‘মুসলিম নবজাগরণের কবি', কেউ ‘মানবতাবাদী কবি' ইত্যাদি নানা অভিধায় বিশেষায়িত করেছেন। ইসলামী আদর্শ ও আরব ইরানের ঐতিহ্য তার কবিতায় উঠে এসেছে বারবার। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা কবিতায় আরবী, ফারশি শব্দের যে স্বার্থক প্রয়োগ শুরু করেন, মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ তা আরও বেগবান করেন। ১৯৪৩ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে ফররুখ আহমদ অসংখ্য কবিতা রচনা করেন। ১৯৪৩ সালে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য 'আকাল' নামে একটি সংকলন প্রকাশ করেন। সেখানে কবি ফররুখ আহমদের বিখ্যাত 'লাশ' কবিতাটি জায়গা করে নেয়। দুর্ভিক্ষ নিয়ে অদ্যাবধি বাংলা সাহিত্যে 'লাশ' এর মত কবিতা লিখতে পারেনি আর কেউ। দুর্ভিক্ষ নিয়ে ব্যাথিত ফররুখ আহমদ লিখলেন, 'যেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে পড়ে আছে জমিনের পর / সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখে না সে মৃতের খবর/।

ফররুখ আহমদ তার 'সাত সাগরের মাঝি' কাব্যগ্রন্থের জন্য অমর হয়ে আছেন। এটি তার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। এ কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। 'সাত সাগরের মাঝি' কাব্যগ্রন্থটি কবি আল্লামা ইকবালের প্রতি উৎসর্গ করেছিলেন ফররুখ আহমদ। মুসলিম ঐতিহ্যের পুনর্জ্জীবন কামনা করে রোমান্টিকতার আবহে কবি জাতিকে জেগে ওঠার আহ্বান করেছেন। যখন অন্যরা জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্যে এগিয়ে যাচ্ছে তখন ফররুখ আহমদ পিছিয়ে পড়া তার নিজ জাতিকে জেগে ওঠার ডাক দেন। ফররুখ আহমদের বিখ্যাত কবিতা হলো 'পাঞ্জেরী'। মুসলিম জাতির পিছিয়ে পড়া, অন্ধকার থেকে পরিত্রাণের আর কত দেরি তা জানতে কবি উৎসুক ছিলেন। কবি আবু রুশদের ভাষায়, 'ফররুখ আহমদ রোমান্টিক কবি। তার কাব্যে সৌন্দর্যের জয়গান অকুণ্ঠ। তিনি নিঃসন্দেহে একজন আধুনিক কবি।'

কবি ফররুখ আহমদকে চরম দারিদ্রতার সঙ্গে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। কিন্তু অর্থের প্রতি, ক্ষমতার প্রতি তার কোনও মোহ ছিল না। দারিদ্রতাকে তিনি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। আরাম আয়েশ, ভোগ বিলাসিতাকে তিনি মন থেকে ঘৃণা করতেন। নিজের কবিতার মতই ছিল কবির দৈনন্দিন জীবন। কবি ফররুখ আহমদের কাব্যগ্রন্থগুলো হলো, সাত সাগরের মাঝি, সিরাজাম মুনিরা, নৌফেল ও হাতেম, মুহুর্তের কবিতা, ধোলাই, হাতেম তাঈ, নতুনরলেখা, কাফেলা, হাবিদা মরুর কাহিনী, সিন্দাবাদ, দিলরুবা'' প্রভৃতি। শিশু সাহিত্যতেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তার রচিত শিশুতোষ গ্রন্থগুলো হল, 'পাখির বাসা, হরফের ছড়া, চাঁদের আসর, ছড়ার আসর, ফুলের জলসা, ঐতিহাসিক অনৈতিহাসিক কাব্য, দিলরুবা' প্রভৃতি তার অমর কীর্তি।

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত মহাকাব্য 'মেঘনাদ বধ' এরপরেই অন্যতম সফল মহাকাব্য ফররুখ আহমদ রচিত 'হাতেম তাঈ'। মুসলিম কবিদের মধ্যে কাব্যনাটক রচনার পথিকৃত তিনি। তার 'নৌফেল ও হাতেম' একটি সফল ও জনপ্রিয় কাব্যনাটক। সনেট রচনাতেও তিনি সফল। বাংলা সাহিত্যে মাইকেলের পরে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে আর কোনও কবি এতো বেশি সফল সনেট রচনা করতে পারেনি। তার সনেট গ্রন্থের মধ্যে, 'মুহুর্তের কবিতা, দিলরুবা প্রধান। গদ্যকবিতা রচনায়ও সিদ্ধহস্ত কবি ফররুখ আহমদ। তার গদ্যকবিতার সংকলন, 'হাবেদা মরুর কাহিনী' লিখে সফল তিনি। ফররুখ আহমদ স্বীকৃতি স্বরূপ অনেক পুরস্কার এবং সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, প্রেসিডেন্ট পদক, প্রাইড অব পারফরমেন্স, আদমজী পুরস্কার, ইউনেস্কো পুরস্কার, অন্যতম। ১৯৭৭ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক এবং ১৯৮০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়।

কবি ফররুখ আহমদ পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উঠতে না পারায় দুর্বিষহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। আদর্শের সঙ্গে আপস না করায় চাকুরিচ্যুত হন। সীমাহীন সংকটের ভেতর দিয়ে জীবনাবসান ঘটে বিরল প্রতিভাধর এই কবির। যে রাজনৈতিক চিন্তার কারনে ফররুখ আহমদকে তার সতীর্থরা নির্বাসিত করেছিল, সে চিন্তা কিন্তু তাকে মোটেও পথভ্রষ্ট করতে পারেনি। টাকার অভাবে রমজান মাসে না খেয়েই রোজা রাখতেন তিনি। ২৭ রমজানে ইন্তেকাল করেন কবি ফররুখ আহমদ। কোথায় তাকে দাফন করা হবে তা নিয়েও সমস্যা দেখা দেয়। প্রখ্যাত সাংবাদিক আসাফউদ্দৌলা রেজাসহ অনেকেই সরকারিভাবে কোন জায়গা পাওয়া যায় কি না সে চেষ্টা করেন। কিন্তু সরকারিভাবে কোনও জায়গা পাওয়া যায়নি। অবশেষে কবি, প্রকাশক বেনজীর আহমদ তার শাহজাহানপুরের পারিবারিক গোরস্থানে কবি ফররুখ আহমদকে দাফন করার জায়গা দেন। এসময় বেনজীর আহমদ দুই হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে বললেন, 'আমার ভাইকে আমার কাছে নিয়ে যেতে দিন'। কবি ফররুখ আহমদের করুণ পরিণতি দেখে আহমদ ছফা লেখেন, আজকের সমগ্র বাংলা সাহিত্যে ফররুখ আহমদের মত একজনও শক্তিশালী কেউ নেই। এমন জ্ঞানী গুণী একজন কবিকে অনাহারে রেখে তিলে তিলে মরতে বাধ্য করেছি আমরা। আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না এটা নিশ্চিত।

বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র কবি ফররুখ আহমদের মৃত্যুদিবস আজ ১৯ অক্টোবর। ১৯৭৪ সালের এই দিনে রাজধানী ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেনের বাসায় অনাহার অর্ধাহার, বিনা চিকিৎসা সহ নানা কষ্টে ভুগে কবি ফররুখ আহমদ ইন্তেকাল করেন। কবি ফররুখ আহমদ বেঁচে থাকবেন তার অমর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কবিকে জান্নাতবাসী করুন।

(তথ্যসূত্র- শুকতারা, আবদুল মান্নান সৈয়দ)

(www theoffnews.com - Bangladesh poet Farrukh Ahmed)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

1 comments so far,Add yours

  1. সমৃদ্ধশীল লেখা।

    ReplyDelete