পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

গরু পাচারকারী, গরু চোর ইত্যাদি নানান শব্দে সরগরম গোটা বাংলা। কিন্তু গরু পাচার আজকেই হচ্ছে বা এই সরকারের আমলেই হচ্ছে তা কিন্তু নয়। গরু পাচার আগেও যথেষ্ট পরিমানে হয়েছে। বাম আমলে কয়লা বা গরু পাচার ছিল অন্যতম শিল্প। সেই আমলে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, দুর্গাপুর – আসানসোল বা বীরভূম এলাকায় সাংবাদিকতার সূত্রে খুব কাছ থেকে দেখেছি এই পাচারগুলি। তখন কি পুলিশ বা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেন? মোটেও না। তাদের প্রত্যক্ষ মদতেই চলত সেই কারবার। পার্থক্য ছিল একটাই এতটা ছড়িয়ে ফেলেননি কেউই। তাই স্থানীয় নেতাদের কাছে টাকা পৌঁছলেও তা পরবর্তীতে দৃষ্টিকটু হয়ে ধরা দেয়নি। অর্থের বিনিময়ে সুবিধা করে দেওয়ার অভিযোগ ছিল পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধেও। কিন্তু রয়ে সয়ে। এখন শাসক দলের নেতারা যেমন ছড়িয়ে ফেলছেন তেমনটা তখন হত না। 

গরুপাচারের কথাতেই যখন শুরু হল, তখন একটা ঘটনা বলি। বছর কুড়ি আগে আমি তখন বীরভূম জেলার সাংবাদিক। জেলার উপর দিয়ে প্রতিদিন শয়ে শয়ে গরু বোঝাই লরি যেত মুর্শিদাবাদের দিকে। প্রতিটি থানাই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে সেই লরি থামিয়ে টাকা তুলত নিয়ম করে। নতুন এক এস পি এসে সেই ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে দেখলেন এভাবে তো স্থানীয় থানা স্তরেই গরুপাচারের টাকা লুঠ হয়ে যাচ্ছে। তাদের কাছে কিছু পৌঁছচ্ছে না। তিনি তখন একটা চিরকুটের ব্যবস্থা করলেন। সেই চিরকুট নগদ টাকা দিয়ে কিনে নিতে হবে মাসের প্রথমেই, তা দেখালেই রাস্তায় আর গাড়ি ধরবে না কোনও থানা। চিরকুটে পুলিশের কোনও নাম চিহ্ন নেই, আছে একটা কাল্পনিক সমাজসেবা মূলক প্রতিষ্ঠানের নাম। মুশকিল হল বড় সাহেবদের রোজগার বেড়ে গেলেও স্থানীয় থানাগুলির রোজগার গেল কমে। ধীরে ধীরে জমল অসন্তোষ। ক্ষুব্ধ পুলিশের একাংশের মাধ্যমেই খবর এল আমার কাছে, এল সেই চিরকুটের কপিও। বেশ কিছুদিন নজর রাখার পর, লুকিয়ে ছবি করে, গরুপাচারের লরি চালকের বাইট নিয়ে সেই খবর করলাম আমরা। সাময়িক বন্ধ হল, পাচার। কিন্তু রেগে গেলেন সেই পুলিশ সুপার, তার অফিসে ডেকে সরাসরি হুমকি দিলেন আমায়, কাজটা নাকি ভাল করিনি। আমিও জানিয়ে দিলাম খারাপ মনে হলে বা অসত্য মনে করলে প্রেস কাউন্সিলে নালিশ করতেই পারেন। সেই সময় বীরভূমে ইটিভির একটা বড় ইভেন্ট ছিল, সেই ইভেন্টে পুলিশ দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিলেন। পরে অবশ্য পুলিশ পাঠিয়ে ছিলেন। উল্লেখ্য তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদেরও এই ব্যাপারে আশীর্বাদ থাকলেও তারা কিন্তু গোটা ঘটনায় চুপ ছিলেন। অর্থাৎ গরু পাচার কিন্তু তখনও হত। যেমন অর্থের বিনিময়ে স্কুলে চাকরি নিয়ে হইচই চার দিকে। আগে যখন স্কুল সার্ভিস কমিশন ছিল না, তখন কি টাকা ছাড়া চাকরি হত? স্কুল কমিটিগুলি তখনও তাদের পেটোয়া লোক ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিতই না, নিলেও টাকার বিনিময়েই তা নেওয়া হত। স্কুল সার্ভিস কমিশন হওয়ার পরেও কিন্তু টাকা নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ওই যে বললাম, সুশৃঙ্খল ভাবে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই এই বেনিয়মের কাজগুলি করা হত, এভাবে ছড়িয়ে ফেলে নয়। 

অনুব্রত মণ্ডলকে আমি চিনি প্রায় বছর কুড়ি আগে থেকে। একটু ভুল বললাম আমি চিনতাম কেষ্ট বা কেষ্টাকে, অনুব্রত যে ওর ভাল নাম সেটা জানলাম অনেক পরে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর। বাম আমলে সেই সময় কেষ্টদা তৃণমূল কর্মী হলেও তার বাইট নেওয়ার পরিস্থিতি তখনও আসেনি। বীরভূম বাম দূর্গ হলেও সেই সময় জেলার পুরসভাগুলির সব কটাই ছিল তৃণমূল অথবা কংগ্রেসের দখলে। তৃণমূলের নেতা বলতে তখন রামপুরহাটের আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ই পরিচিত ছিলেন। একদিন হয়েছে কি, কোনও একটা কাজে বিশ্বভারতীতে গিয়েছি। বিকেল সাড়ে তিনটে চারটে বাজে। কি মনে হল হঠাৎই বোলপুর পুরসভায় ঢুঁ দিলাম। তৃণমূল পরিচালিত ওই পুরসভায় তখন চেয়ারম্যান চন্দ্রনাথ সিংহ, যিনি বর্তমানে মন্ত্রী। হঠাৎ গিয়ে দেখি চেয়ারম্যানের ঘরে বসে চন্দ্রনাথদা সহ কয়েকজন মুড়ি সিঙ্গাড়া সহযোগে বেজায় আড্ডা চলছে। সেই আড্ডায় রয়েছেন কেষ্টদাও। আমি হঠাৎ যেতেই শশব্যস্ত সকলে। কি ব্যাপার, সিউড়ী থেকে আমি চলে এসেছি, গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে কিনা তা নিয়ে খুবই চিন্তায় সকলে। অভয় দিয়ে বসতেই চা সিঙ্গাড়ার অফার। খানিক গল্পগুজব করে চলে আসার পর শুনেছিলাম আমার বোলপুরের তৎকালীন সহকর্মী সুজিতকে কেষ্টদা নাকি অনুযোগ করে বলেছিলেন “পলাশদা হঠাৎ চলে এলেন, তুমি একটা ফোন তো করবে আমাদের। এই আড্ডা দেখে উনি কি ভাবলেন বল তো?” হ্যা তখন পলাশদাই বলতেন। এখন যেমন শুনেছি কেষ্টদা স্থানীয় সব সাংবাদিককেই নাম ধরে তো ডাকেনই, তুই করেই বলেন। ২০০৬ সালে আমি বীরভূম ছেড়ে আসার পর একবারই কেষ্টদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সেও বছর পনেরো আগে, সামান্য সৌজন্য মূলক কথাবার্তা হয়েছিল। তারপরে আর দেখা বা কথাবার্তা হয়নি। তবে কেষ্টদার এই বেড়ে ওঠার পিছনে তার নিজের প্রতিভা ক্ষমতা কতটা আছে আমি ভাল জানি না কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়েছে সংবাদ মাধ্যম তাকে অনেক বেশি বিখ্যাত হতে সাহায্য করেছে। তার অদ্ভুত কথাগুলি বার বার প্রচার করা, তাকে নিয়ে নানা ধরনের মিথ ছড়িয়ে দেওয়া, তাকে দারুণ সংগঠক হিসেবে তুলে ধরা, অনেকটাই মিডিয়ার দান, যেমনটা করা হয়েছিল মুকুল রায়কে নিয়েও। মুকুল নাকি চাণক্য, তিনিই সব জয়ের কারিগর ইত্যাদি ইত্যাদি। তেমন বীরভূমেও যে কোনও নির্বাচনে তৃণমূল ভাল ফল করলেই গোটা কৃতিত্ব কেষ্টকে দিয়ে ফলাও প্রচার মিডিয়ার একটা পছন্দের বিষয়। এখনকার মিডিয়া মশলা খোঁজে, খবর রান্নায় যা কাজে লাগবে। কেষ্টদা নিয়মিত সে মশলা সাপ্লাই দিয়ে গিয়েছেন। এখনও দিচ্ছেন। তৃণমূলের আর কোনও জেলা সভাপতির ভাগ্য এমন সুপ্রসন্ন নয়, বলা ভাল বহু মন্ত্রীরও এমন ক্যারিশমা নেই। 

বার বার গরু পাচারের কথা বলা হচ্ছে। বীরভূমে শুধু কি গরুপাচারের টাকাই ওড়ে? পাথর বা বালি কি কিছু কম আছে? জেলার পশ্চিম অংশ জুড়ে ঝাড়খণ্ড সীমানা বরাবর মাইলের পর মাইল জুড়ে পাথরের খাদান। হাজার হাজার লরি সেই পাথর নিয়ে প্রতিদিন চলে যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। লরি পিছু মোটা টাকা কে বা কারা নেয় সেটা জানেন জেলার অধিকাংশ মানুষই। একই ভাবে ময়ুরাক্ষী, অজয়, দ্বারকা, বৈধরা থেকে লরির পর লরি বালি উঠছে ফি দিন, কাদের মদতে? সেটাও জানেন সকলেই। তাই শুধু গরু পাচার থেকেই এই বিপুল সম্পদের অধিকারী তা ভাবলে চলবে না। 

বর্ধমানকে আগে ধনী জেলা বলা হত। ধান বা চালের বৈধ টাকা তো ছিলই, সঙ্গে ছিল কয়লা এবং লোহা পাচারের কালো টাকাও। কিন্তু এখন টাকা ওড়ে বীরভূমে। পাশের জেলার আর্থিক বাড়বাড়ন্তে খানিক ফিকে বর্ধমান। বছর দশেকের মধ্যে জেলায় পাথরের ডাম্পারের পরিমান কয়েকশো গুণ বেড়েছে। ওভার লোডেড সেই ডাম্পারের চাপে বীরভূমের রাস্তাঘাটের হাল খারাপ বারো মাস। এখন তো আবার বীরভূমেও কয়লা খনি মিলেছে। এবার তার টাকাও যোগ হবে। তাই রয়ে সয়ে খেতে হবে। বাম নেতাদের দেখে শিখলেও, ছাত্র হিসেবে তৃণমূল মোটেই ভাল নয়। তাই পরীক্ষায় ঠিকঠাক নকল করতে না পারায় বার বার ধরা পড়ে ল্যাজে গোবরে অবস্থা তৃণমূল নেতাদের। 

আর একটা কথা না লিখলে এই লেখাটা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। ইডি, সিবিআই আয় বহির্ভুত সম্পত্তি নিয়ে হানা দিচ্ছেন বীরভূমে নানা নেতা বা নেতা ঘনিষ্টদের বাড়ি। কিন্তু যাদের মাধ্যমে আপনি আমি এই ঘটনার কথা জানতে পারছি সেই সাংবাদিকদের একাংশও নাকি আতস কাচের তলায় বলে শুনেছি। কারন সামান্য বেতনের কয়েক জন সাংবাদিকের বিলাসবহুল সুবিশাল বাড়ি, দামী গাড়ি, একাধিক স্থাবর সম্পত্তি, উচ্চমানের জীবন যাপন নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তাদের এই জীবনযাত্রার মান মাত্র বছর দশেকের মধ্যেই এক লাফে মাটি থেকে আইফেল টাওয়ারে পৌঁছেছে কিভাবে সেটাও বেশ আলোচনার বিষয় সাধারণ মানুষের মধ্যে। সব মিলিয়ে সংস্কৃতির ঐতিহ্যে গর্বিত বীরভূম এখন অর্থের আভিজাত্যে উজ্জ্বল সব দিক থেকেই।

(www.theoffnews.com - cow Anubrata Mondal)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours