পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর। সন্ধ্যার সময়ে জানা গেল, পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট বাতিল পরদিন থেকেই। উদ্দেশ্য, কালো টাকা উদ্ধার এবং সেই সূত্রে জাল টাকা, সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা। পাশাপাশি, ডিজিটাল, নগদহীন অর্থনীতির দিকে হাঁটা। এ যুগের লৌহপুরুষের এমন দুঃসাহসিক পদক্ষেপে অনেকে ধন্য ধন্য করে উঠেছিলেন। কিছু অর্থনীতিবিদ বা নাগরিক সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের ঠারেঠোরে 'দেশদ্রোহী' বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। পরের দিন সকাল থেকে ব্যাঙ্ক ও এটিএম-এর সামনে লম্বা লাইন। ব্যাঙ্ক কর্মীদের দুর্বিষহ দিনযাপন। ঘন ঘন নির্দেশিকা বদল। সাধারণ নাগরিকদের চূড়ান্ত হয়রানি। উপরি পাওনা বেশ কিছু মৃত্যু। ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলি, যাদের দৈনন্দিন ব্যবসা নগদ-নির্ভর তারা রুগ্ন হতে শুরু করল। বহু মানুষজন কর্মহীন হয়ে পড়লেন। বিশেষ করে অর্থনীতির অসংগঠিত ক্ষেত্রে ভয়াবহ কাঁপন ধরল। ঝাঁকুনিটি যে মোক্ষম হয়েছিল, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন এ দেশের মানুষ। গেরুয়া শিবিরের দাবি, এই ঝাঁকুনি  অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কেন না কালো টাকার বিরুদ্ধে জেহাদ, কাশ্মীরে উগ্রপন্থীদের ভাতে মারবার পরিকল্পনা, নকল টাকা রোখার ক্ষেত্রে এ দাওয়াইয়ের নাকি জুড়ি নেই।

২০১৯-এর এপ্রিলে ফিনান্সিয়াল ইন্টালিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, শুধু নোটবন্দির পরের অর্থবর্ষেই (২০১৭-১৮) দেশে সন্দেহজনক লেনদেনের খবর এসেছে প্রায় ১৪ লক্ষ। আগের তুলনায় ১,৪০০ শতাংশ বেশি। এর আগে ২০১৩-১৪ সালে ৬১,৯৫৩টি, ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে ৫৮,৬৪৬টি এবং ২০১৫-১৬ সালে ১,০৫,৯৭৩টি সন্দেহজনক লেনদেন ধরা পড়েছিল। সেই বছরই ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো বা এনসিআরবি-র প্রকাশিত তথ্য জানিয়েছিল, ২০১৭ সালে প্রায় ২৮ কোটি টাকার জাল নোট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। যা তার আগের বছরের প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৬-য় দেশে প্রায় ১৫.৯ কোটি টাকার জালনোট বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। এনসিআরবি-র তথ্য অনুযায়ী নোট বাতিলের পরে জালনোট কমেনি, বরং বেড়েছে। ২০১৯ সালে এনসিআরবি-র রিপোর্ট জানিয়েছিল, নোট বাতিলের পরে যে-দু'হাজার টাকার নোট বাজারে ছাড়া হয়েছিল, ২০১৭ সালে প্রায় ৭৫ হাজারটি সেই নোট জাল হয়েছে। ২০১৭ সালে সব চেয়ে বেশি জালনোট (৮০,৫১৯টি, টাকার অঙ্কে ন'কোটি) বাজেয়াপ্ত হয়েছে গুজরাত থেকেই। দ্বিতীয় স্থানে ছিল দিল্লি (বাজেয়াপ্ত ছ'কোটি ৭৮ লক্ষ টাকার জালনোট)।

'সুইস ব্যাঙ্ক থেকে কালো টাকা ফিরিয়ে আনব। প্রত্যেক দেশবাসীর অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমা করব।' ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে নরেন্দ্র মোদির প্রতিশ্রুতি।  আট বছরেও সেই টাকা তো আসেইনি। সুইস ব্যাঙ্কের দেওয়া পরিসংখ্যান বলছে, মোদি দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সুইজারল্যান্ডের ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের আমানতের পরিমাণ হু হু করে বেড়েছে। এমনকি, কোভিড কালে সেই টাকার অঙ্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকায়, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সুইস ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক (এসএনবি)-র তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের শেষ দিকে সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের তহবিলের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালের শেষে তা ২০ হাজার ৭০৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, মাত্র এক বছরে কালো টাকার অঙ্ক বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা জমা হয়েছে বন্ড, সিকিউরিটিস এবং অন্যান্য আর্থিক প্রক্রিয়ায়। ৪ হাজার কোটির বেশি গ্রাহকরা নিজে জমা করেছেন। ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি এসেছে অন্য ব্যাঙ্ক থেকে এবং সাড়ে ১৬ কোটি টাকা বিভিন্ন ট্রাস্ট মারফত। 

তথ্য বলছে, ২০১৮, ২০১৯, পর পর দু'বছর সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ কমছিল। কিন্তু ২০২০ সালে তা এক লাফে আগের বছরের তুলনায় ২৮৬ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। অথচ, অর্থ মন্ত্রকের যুক্তি, গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ বাড়লেও কালো টাকা জমার পরিমাণ বাড়ার কোনও যুক্তি নেই। কারণ ভারত-সুইজারল্যান্ডের মধ্যে কর ফাঁকি সংক্রান্ত বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার চুক্তি হয়েছে। প্রতি বছর আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য আদানপ্রদানেরও চুক্তি হয়েছে। ২০১৯ ও ২০২০, দুই বছরই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত তথ্য আদানপ্রদান হয়েছে। এই আইনি চুক্তি কর ফাঁকির কালো টাকা সুইস ব্যাঙ্কে জমা রাখার সম্ভাবনা অনেকখানিই কমিয়ে দেয়।

কিন্তু বিরোধীরা পাল্টা তিনটি প্রশ্ন তুলেছেন। এক, গত এক বছরে যে সব ব্যক্তি সুইস ব্যাঙ্কে টাকা জমা করেছেন, তাঁরা কারা? যেখানে ৯৭ শতাংশ ভারতীয় আরও গরিব হয়েছেন সেই সময় কারা সুইস ব্যাঙ্কে টাকা ঢুকিয়েছেন? দুই, গত সাত বছরে কোন দেশ থেকে কত কালো টাকা কেন্দ্রীয় সরকার ফেরত এনেছে? তিন, বিদেশি অ্যাকাউন্ট থেকে কালো টাকা সরানো রুখতে কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে মোদি সরকার? এখনও এর কোনও উত্তর মেলেনি।

প্রণব মুখোপাধ্যায় 'দ্য প্রেসিডেন্সিয়াল ইয়ার্স: ২০১২-২০১৭' বইয়ে লিখেছিলেন, তাঁকেও নোটবাতিলের বিষয়ে আগে জানানো হয়নি। আগাম পরামর্শ করেননি মোদি। দেশের অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে মোদি এবং তার সরকারের মতপার্থক্য ধারাবাহিক। উর্জিত প্যাটেল, রঘুরাম রাজন, বিরল আচার্য প্রভৃতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর বা ডেপুটি গভর্নররা মেয়াদ ফুরনোর আগেই ইস্তফা দিয়েছেন সরকারি খবরদারি সইতে না পেরে। মেয়াদের আগেই ইস্তফা দেন দেশের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যমও। তারা সকলেই এই নোটবন্দির সিদ্ধান্তের সরাসরি বিরোধিতা করেছেন। মোদি সরকারের নোটবন্দির নাটকীয় সিদ্ধান্তকে নির্মম বলেছেন অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম। বছর খানেক আগে প্রকাশিত তার লেখা বই 'অফ কাউন্সেল: দ্য চ্যালেঞ্জেস অব মোদি-জেটলি ইকনমি'-তে  ছত্রে ছত্রে লেখা রয়েছে সেই নির্মমতার কথা। অর্থমন্ত্রী ও উপদেষ্টা সুব্রহ্মণ্যমকে অন্ধকারে রেখেই নাকি ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। আজ স্পষ্ট, নোটবাতিল নামক তাণ্ডবটি সম্পূর্ণ অনর্থক ছিল। নোটবাতিলের পিছনে অর্থনীতির যুক্তি যতটা ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল শুধু একজন রাজনীতিকের একনায়কচিত সিদ্ধান্ত। 

তর্কের খাতিরে বলতেই হয়, যে নোটবন্দি নিয়ে এত আক্রমণ, মানুষ তা সহজে মেনে নিল কি করে? নোটবন্দির পরেই উত্তরপ্রদেশে কি ভাবেই বা বিপুল ভোটে জিতে মসনদ দখল করেছিল বিজেপি? এর  সম্ভাব্য উত্তর রয়েছে সুব্রহ্মণ্যম এর বইটিতে। তিনি লিখেছেন, সম্ভবত বড়লোকরা বিপদে পড়বে, এই আশায় যাবতীয় কষ্ট মেনে নিয়েছিলেন দেশের গরিবরা। প্রচারও করা হয়েছিল সেই ভাবেই। বিজ্ঞাপন বা প্রচারে মোদি সবসময়েই বিরোধীদের গোল দিয়ে এসেছেন বলে বলে। এক্ষেত্রেও তাই ছন্নছাড়া বিরোধীরা কিছু বলবার আগেই গরীব মানুষের জন্যই এই নোটবাতিলের সাহসী সিদ্ধান্ত, যা মোদির মত ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতি সম্পন্ন মানুষের পক্ষেই করা সম্ভব বলে প্রচারে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল গেরুয়া শিবির। আদতে যে তা হয়নি তা জাল নোটের বাড়বাড়ন্ত, জম্মু কাশ্মীরে লাগাতার জঙ্গীহানার ঘটনা থেকেই প্রমাণিত। মোদি সরকারের এই নোটবন্দি কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল তা বোঝাতে সম্প্রতি একটা হিন্দি ওয়েব সিরিজও প্রকাশিত হয়েছে। বাংলার অভিনেতা আবির চট্টোপাধ্যায় তাতে অভিনয় করেছেন। কিন্তু নোটবন্দির বোঝার উপর শাকের আঁটি করোনাকালে কাজ হারানো। এই দুইয়ের চাপে পড়ে অসংখ্য কর্মহীন গরীব থেকে আরও গরীব হওয়া মানুষগুলি কতদিন এই বিজ্ঞাপনে ভুলে থাকবেন তা সময়ই বলবে।

(www.theoffnews.com - demonetisation)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours