ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

যোগ্য ব্যক্তিকে পুরস্কার দেওয়ার মধ্যে যেমন জাতির মর্যাদা বাড়ে, তেমনি অযোগ্য ব্যক্তিকে পুরস্কার দেওয়াতে জাতি হিসেবে অসম্মানিত হতে হয়। যে ব্যক্তি পুরস্কার গ্রহন করেন তিনি সমাজে মর্যাদা পান। শুধু কি পুরস্কার গ্রহনেই মর্যাদা নিহীত থাকে, কখনো কখনো পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া বা বর্জনের মাঝেও আত্মমর্যাদার পরিচয় পাওয়া যায়। একবার ভারতবর্ষের বাঙালি লেখক অমিতাভ ঘোষের একটি বই কমলওয়েলথ পুরস্কারের তালিকায় চলে আসে, ঔপনিবেশিক সিলসিলা যুক্ত এই পুরস্কার থেকে তিনি নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। কেননা, পুরস্কারের জন্য বইটি জমা দিয়েছিলেন তার প্রকাশক। ঠিক এর উল্টো ঘটনা ঘটেছে আমাদের দেশে। আমাদের এক লেখিকার ইংরেজিতে লেখা বই একই পুরস্কার তালিকায় অর্ন্তভূক্ত হয়, অথচ এই নিউজ তাদের পারিবারিক গণমাধ্যমের মাধ্যমে রীতিমতো হৈচৈ কান্ড বাঁধিয়ে ফেলেছিলেন। এখানেই আত্মমর্যাদার পার্থক্য। কেউ ফিরিয়ে দিয়ে সম্মানিত হয়, কেউ জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে গর্ববোধ করেন।

এখানেই থেমে নেই। আর্ন্তজাতিক মহলে পুরস্কার নিয়ে প্রতিবাদের অনেক ঘটনা রয়েছে। পুরস্কার গ্রহন করে বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার ঘটনাও রয়েছে উল্লেখযোগ্য। ১৯৭০ দশকে সাহিত্যে সুইডিশ একাডেমির দুই সদস্য নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেন। তারা পুরস্কারের জন্য যোগ্য ছিলেন। তারপরও পুরস্কার গ্রহণ করার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। কথা উঠেছিল, সুইডিশ একাডেমির সদস্যরা নিজেদের পুরস্কার নিজেরাই গ্রহণ করেছেন। এক পর্যায়ে নানামুখী সমালোচনা সহ্য করতে না পেরে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি হেরি মার্টিনসন আত্মহত্যা করেছিলেন।

পুরস্কার নিয়ে আত্মমর্যাদার কথা যেমন আছে তোষামোদের কথাও তেমন আছে। যুদ্ধের পক্ষে ওকালতি করে কারো কারো শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ঘটনাও আছে। একই ভাবে গণহত্যার পক্ষে রসদ জুগিয়েও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ঘটনার দৃষ্টান্তও আছে। এমনই এক বড় উদাহরণ হেনরি কিসিঞ্জার। বাংলাদেশেও এমনই একটি নোবেল পুরস্কারের কথা উল্লেখ আছে। যে কাজ পুরস্কারে শান্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়, সেই কাজটি এ দেশের সাধারন মানুষের মনের শান্তি বিঘিন্ত করে। অথচ এই শান্তি বিঘ্নকারী ব্যক্তিই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এসব মানুষ খারাপ কাজ করেও নিজেকে ভাল কাজের অংশীদারী করতে ভাল সনদ হিসেবে পুরস্কার পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। অথচ তারা জানেই না, পুরস্কারের সনদ কখনো খারাপ মানুষকে ভালমানুষে পরিণত করে না। তারা সবসময় মানুষের মনের ভেতর খারাপ মানুষের প্রতীক হিসেবে অর্ন্তনিহিত থাকেন। 

আজকাল প্রায়ই দেখা যায় সরকারী কর্মকর্তারা সরকারী পুরস্কার পেয়ে থাকেন। আদৌ এবিষয়টা কতোটা যুক্তিপূর্ণ। সরকারী কর্মকর্তাগণ মনোনয়ণ দলের অর্ন্তভূক্ত, আবার সরকারী কর্মকর্তাগণই পুরস্কার পাচ্ছেন। তাহলে বিষয়টি দাঁড়ালো নিজের ঘরের জিনিস নিজেরাই ভাগ বাটোয়ারা করে নিচ্ছি। এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল শিল্পকলা একাডেমিতে। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচনা প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়েছিল। পুরস্কার হিসেবে অর্থ দেওয়ার ঘোষনা করা হয়েছিল। সেখানে প্রায় ৭০% পুরস্কার জিতেছিলেন শিল্পকলার কর্মচারীদের সন্তান এবং আত্মীয়-স্বজন। যদিও সেখানে উল্লেখ ছিল উক্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের সন্তান বা আত্মীয়স্বজন অংশগ্রহন করতে পারবে না। ঠিক একই ভাবে সরকারী কর্মকর্তাদের কলাম, সাহিত্য- কবিতা আগ্রহ নিয়ে ছাপানো হয় পত্রিকায় বা ম্যাগাজিনে। এর কারণ হিসেবে দেখা যায় সরকারী ও কর্মচারী বা কর্মকর্তার দায়িত্বভুক্ত সুযোগ-সুবিধা আদয় করা। শুধু তাই নয় বছর শেষে বই আকারেও প্রকাশ করার ব্যাপারে বেশ উৎসাহিত প্রকাশকগণ। অথচ পদমর্যাদা থেকে অবসর নেওয়ার পর এসব অতি উৎসাহী লেখকদের খুঁজে পাওয়া যায় না।

সাধারন জনগণের ধারনা রাষ্ট্রীয় কোন কাজে অর্ন্তভূক্ত হতে হলে অবশ্যই এনএসআই রিপোর্ট জরুরী। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার প্রাপ্ত ব্যক্তির এনএসআই রিপোর্ট থাকবে না এটা কি করে সম্ভব! প্রতিবছর পুরস্কার পাওয়ার পরে বিতর্ক হচ্ছে এবং তারপর তার সম্পর্কে অজানা অনেক রহস্য বেরিয়ে আসছে। তবে এই রহস্য কেন পুরস্কারে মনোনীত করার আগে অনুসন্ধান করা হচ্ছে না। তাছাড়া যে ব্যক্তি পুরস্কৃত হচ্ছেন শুধুমাত্র তিনিই শাস্তি হিসেবে পুরস্কার বাতিল বলে গণ্য হচ্ছেন। তবে রয়ে যাচ্ছেন সেই ব্যক্তিগণ, যাদের হাত ধরে এসব বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন করা এবং পুরস্কার দেওয়া হয়। তাদের জন্য শাস্তি হিসেবে কি ধার্য করা হয়েছে সেটা জানার অধিকার জনগনের আছে। 

আরো একটি বিষয় বলতে চাই, তা হলো রাষ্ট্রীয় এসব পুরস্কারের কমিটি গঠন করা হয় সরকারী আমলাদের নিয়ে। সাহিত্যে কে ভাল কে খারাপ বা কার কতোটুকু যোগ্যতা আছে তা অফিসের ফাইল ঘেটে জানা সম্ভব? মেডিসিনের ডাক্তার নিশ্চয়ই সার্জারী করতে পারেন না! সুতরাং যার যা কাজ তাকে সেই দায়িত্ব দিলেই বোধ করি ভাল হয়। তা না হলে প্রতিবছর পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার মতো হাস্যরসাত্মক যবনিকা টানতে হবে।

পাশ্চবর্তী দেশ বা বিশ্বে পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার অনেক রকম নজির থাকলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে এর কোন দৃষ্টান্ত নেই। একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। করোনার আগে এক অনুষ্ঠানে শিল্পকলায় এক মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। প্রথম থেকে দ্বিতীয় সারিতে বসে আছি। সামনের সারিতে সাধারনত দেশের সম্মানীত অতিথিগণ বসেন। একজন বিশেষ অতিথি একটু পরে এসেছেন। তিনি বসবেন অথচ সামনের সারিতে খালি চেয়ার নেই। আয়োজকদের একজন এসে দেখলেন সেখানে অদ্ভুত সাজে এক সুন্দরী রমনী বসে আছেন। তাকে কেউ চেনেন না। নমনীয় ভাবে তাকে বিশেষ অনুরোধ করলেন, আপনি পেছনের চেয়ারে বসুন, আমাদের নির্ধারিত চেয়ারে অতিথি বসবেন। ওই রমনী উঠবেন না বলে ঝগড়া শুরু করলেন। তার মতে আমি আগে এসেছি তাই উঠবো না। এই সময় মন্ত্রী বক্তব্য দিচ্ছিলেন। ওই রমনীর চিৎকার শুনে মন্ত্রী থেমে গেলেন। রীতিমতো হট্টোগোল শুরু হয়ে গেল। আমি পেছনে বসে লজ্জা পাচ্ছি ওই রমনীর আচরণ দেখে। অথচ তাঁর কোন লজ্জাতো নেই বরং ঝগড়া করে হলেও যেন চেয়ার টিকিয়ে রাখতেই হবে। আমাদের দেশের পুরস্কার পাওয়া যেন ওই রমনীর চেয়ার দখলের মতো। একবার পেলে কিছুতেই হাতছাড়া করার কথা ভাবতে পারে না। (সমাপ্ত)

(www.theoffnews.com - Bangladesh West Bengal literature prize)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours