চন্দ্রিমা দত্ত (সাঁজবাতি), লেখিকা ও শিক্ষিকা, শ্রীরামপুর, হুগলি:
পারিবারিক কৌলিন্যহীন দারিদ্রলাঞ্ছিত রামকিঙ্করকে (১৯০৬-১৯৮০) প্রখ্যাত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ১৯২৫ সালে শান্তিনিকেতনের আনন্দযজ্ঞশালায় এনে তুলে দিয়েছিলেন নন্দলাল বসুর হাতে। তখন রামকিঙ্কর উনিশ বছরের যুবা। নন্দলাল, তাঁর হাতের কাজ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, "তুমি তো সবই জানো, আবার এখানে কেন?... আচ্ছা, দু তিন বছর থাকো তো!" সেই দু তিন বছর কখনও শেষ হয়নি! এখনও না!
সাধনা চলছিল... নিজেকে ছাপিয়ে যাবার সাধনা। শান্তিনিকেতনে তিনিই প্রথম ভাস্কর। কোনও বাধা না মেনে, কারোর ফরমায়েশি কাজ না করে আপন খেয়ালে সৃষ্টি করেন 'সুজাতা' মুর্তি (১৯৩৫)। রবীন্দ্রনাথ সেই মুর্তি দেখে তরুণ ভাস্করকে অনুপ্রাণিত করে বলেছিলেন, 'সমস্ত আশ্রম জুড়ে এর চেয়েও বড় বড় মুর্তি গড়ে ভরিয়ে দিতে পারবি?'
শান্তিনিকেতনে তাঁর মুর্তিগুলি সবই খোলা আকাশের নীচে (তাঁর একান্ত নিজস্ব ইচ্ছানুযায়ী)। তাঁর বানানো মুর্তি গুলির মধ্যে সুজাতা, বুদ্ধ, গান্ধী, সাঁওতাল পরিবার, হার্ভেস্ট, রবীন্দ্রনাথ -বিমূর্ত এবং আরও অনেক।
সেই সময় শান্তিনিকেতনে আনা হতো সেজান, ভ্যান গগ, মাতিস ও পিকাসোর মতন যুগান্তকারী শিল্পীদের অসামান্য ছবির ছাপা বই। রবীন্দ্রনাথও বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে ছবি এঁকে চলেন ...সেসব দেখে শুনে প্রাণিত হয়েছিলেন রামকিঙ্কর। ছবিও আঁকতেন নিজের স্বাধীন ইচ্ছায়। দেখতেন রবীন্দ্রনাথ কি ভীষণ ভাবে সাধনা-রত। রবীন্দ্রনাথের বিমূর্ত ছবিতে রবীন্দ্রনাথ এমন সব কথা বলতে চাইতেন, যা তাঁর বাক্যের সৃষ্টিতে বলা হয়নি। তাঁর মনে হয়েছিল ছবির ভাষা দূর ভবিষ্যতে রসিকজনের কাছে যে বার্তা পৌঁছাবে, কবিতা বা গানের ভাষা ততখানি নয়! প্রমাণ মিললো ১৯৩২ সালে প্যারিসে প্রকাশিত হল রবীন্দ্রচিত্রকলা। এসবই রামকিঙ্করকে মাতিয়ে তুলল। ক্রেয়ণ পেন্সিল, ওয়াশ ও টেম্পারা পদ্ধতিতে ছবি আঁকতেন রামকিঙ্কর। তাঁর ছবির সংখ্যাও অনেক, তবে বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে।
কখনোই টাকার বিনিময়ে ছবি আঁকেননি বা মুর্তি গড়েননি। অথচ দারিদ্র্য তাঁর জীবনের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে ছিল। অধ্যাপনা করে যে সামান্য বেতন পেতেন তাতেই খুব খুশি থাকতেন। আর, রবীন্দ্রনাথও তৎকালীন শান্তিনিকেতনের প্রতিকুলতার হাত থেকে বরাবর রক্ষা করে গেছেন তাঁকে।
রামকিঙ্করের ছবিতে বা ভাস্কর্যে তিনি নিজেকে ছিঁড়ে, দুমড়ে ফেলতে ফেলতে সটান কর্কশ, রুক্ষ দগ্ধ এক লাবণ্যের গভীরে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন - অবোধ দর্শককেও তাইই করিয়েছেন।
পাগলের মতন কাজ করতেন! মাথায় টেকো দিয়ে কাজ করলেও গোটা গা রোদ বৃষ্টি পেত। খাওয়া দাওয়া করতেনও না ঠিকমতন! এতটাই নিবেদন ছিল তাঁর কাজে। ফলে শরীরটা ভেঙেও গিয়েছিল। তিনি মানতেন শ্রমই সবচেয়ে সুন্দর এবং এই সুন্দরই সমাজকে সৌন্দর্য দেয়। বেঁচে থাকাকেই পরিণতি দিয়েছেন তিনি তাঁর শিল্পে।
কিন্তু, সুন্দরের ধারণা আর "শিল্পের জন্য শিল্প" এই ধারণাকে কখনও গুলিয়ে ফেলেননি তিনি। তাই তিনি রামকিঙ্কর। রামকিঙ্কর বেইজ।
(www.theoffnews.com - Ramkinkar Baij)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours