ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

বিশ্বকবির জন্মতিথিতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে নিরলস সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এই সংবাদের ভিত্তিতে দুই বাংলায় বিতর্কের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। যে কবিতার জন্য তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন সেগুলো দেখে আমি এক মিনিট স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মনে মনে দুঃখও প্রকাশ করেছিলাম। কারণ পশ্চিমবঙ্গের কবি বা লেখকগণ সত্যি আত্মমর্যাদাপূর্ণ। তারা নিজেদের ক্ষমতা বা টাকার কাছে বিক্রি করেননি। তা না হলে একজন মুখ্যমন্ত্রী তিনি চাইলে কি না করতে পারতেন। তিনি চাইলে সবচেয়ে ভাল কবিতা বা সাহিত্য রচনার বিপরীতে পুরস্কার গ্রহণ করতে পারতেন। অথচ তিনি একজনও টাকার কাছে বিক্রি হওয়া লেখক খুঁজে পাননি। অথচ বাংলাদেশে বিগত দিনে বা বর্তমান সময়ে অনেক নাম করা লেখক-সাহিত্যিকদের দেখি টাকার বিনিময়ে ক্ষমতাধর কর্তা-ব্যক্তিদের লেখা সাপ্লাই দেন। বিনিময়ে ধনী লেখক এবং ক্ষমতাধর লেখকের তকমা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান নির্লজ্জের মতো। তাই বাংলাদেশের এসব পেইড লেখকদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের দিকে তাকান, তারা উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। সেই সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সমবেদনা জানাই। অন্তত তিনি নিজের লেখায় পুরস্কার পেয়ে তিরস্কৃত হয়েছেন। কোন ছলচাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করেন নাই।

আমার বোধ আসছে না, একটি রাজ্যের সর্বচ্চো ক্ষমতাধর ব্যক্তি মুখ্যমন্ত্রী। তিনি কেন সাহিত্যে পুরস্কার পাবেন না? অবশ্যই পাবেন, তিনি যদি একজন সাহিত্যিক হয়ে থাকেন তবে অবশ্যই তিনি সাহিত্যে পুরস্কার পাওয়ার অধিকার রাখেন। কিন্তু শ্রীমতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সারাজীবনেও একটি কবিতা লেখেন নাই। এমনকি ছাত্রজীবনেও তিনি সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। সেই ব্যক্তির হঠাৎ কেন মনে হলো এমন আজগুবি কবিতার বিনিময়ে আকাদেমী পুরস্কার পেতে হবে? এই ইচ্ছাটা হয়তো বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী ও বাংলা আকাদেমির সভাপতি শ্রী ব্রাত্য বসুকে দেখে জেগেছে। কারণ তিনি এ বছর ‘মীরজাফর ও অন্যান্য নাটক’ গ্রন্থটির জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। অথচ সভাপতি হয়ে মূখ্যমন্ত্রী পুরস্কার পাবেন না তা কি করে হয়! জানা গেছে, মমতার পুরস্কারে ব্যথিত হয়ে সাহিত্য একাডেমির বাংলা ভাষা বিষয়ক উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য অনাদিরঞ্জন বিশ্বাস পদত্যাগ করেছেন। বর্ধমানের বাসিন্দা গল্পকার ও লোক-সংস্কৃতি গবেষক রত্না রশিদ বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েক বছর আগে বাংলা আকাদেমি থেকে প্রাপ্ত ‘অন্নদাশঙ্কর রায় স্মারণ সম্মান’ ফিরিয়ে দেন। সঙ্গে পুরস্কার হিসেবে প্রাপ্ত দশ হাজার টাকাও ফেরত দিয়েছেন।

বেশ কয়েক বছর যাবৎ বাংলাদেশের জাতীয় পুরস্কার নিয়ে বিচ্ছিন্ন মতানৈক্য ঘটতে দেখা গেছে। অচেনা-অজানা ব্যক্তিদের নামে বারবার জাতীয় পুরস্কারের নাম চলে এসেছে। শুধু নাম প্রকাশেই থেমে নেই, পুরস্কার যথাযথ ভাবে নামসর্বস্ব ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেওয়াও হয়েছে। এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল ২০২০ সালে একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারের ক্ষেত্রে। পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় কিছু ব্যক্তির নাম আসা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। একুশে পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় ছিলেন একজন কবির প্রাক্তন স্ত্রী। যার একটি মাত্র অনুবাদ বই প্রকাশিত হিসেবে পাওয়া গিয়েছে। অন্যদিকে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় ছিলেন একজন সাবেক আমলার নাম। এ সময় তখনকার বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন, ‘এবার সাহিত্যে পুরস্কার পেলেন রইজ উদ্দীন, ইনি কে? চিনি না তো’। 

বাংলা একাডেমির পুরস্কারের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটতে দেখা গিয়েছে অনেকবার। ২০২১ সালে বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান অভিনেত্রী বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন। অন্যকে দেওয়া ইন্টারভিউগুলো একত্রিত করে স্মৃতিচারণ মুলক বই প্রকাশিত হতেই পারে। তবে সেই বই সাহিত্যের মাপকাঠিতে কখনো জাতীয় পুরস্কার পেতে পারে এটা মনে হয় বিরল ঘটনা। তাছাড়া বইটি যারা পড়েছেন তারা বলতে পারবেন সেখানে কি লেখা আছে। একজন মানুষ সব বিষয়ে পারদর্শী হতে হবে এমন কোন কথা নেই। যিনি অভিনয়ে তুখোড়, তিনি ভাল লেখক বা সাহিত্যিক হতে পারবেন এমন কোথাও লেখা নেই। এমন বিতর্কিত পুরস্কারের ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই মুখ টিপে হেসেছেন। তবে কলম ধরতে লজ্জাবোধ করেছেন।

২০২২ সালে সাহিত্যে স্বাধীনতা (মরণোত্তর) পুরস্কারে মনোনীত হয় মো. আমির হামজা। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননায় ভুষিত ব্যক্তির পুরস্কার প্রাপ্তির নাম প্রকাশের পর সর্বমহলে বিতর্কের ঝড় ওঠে। সাহিত্য মহলে পরিচয়হীন ব্যক্তির লেখা তিনটি বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে তা হলো ‘বাঘের থাবা’, ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি’, ‘এককুশের পাঁচালি’। এমনকি তিনি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন। জানা যায় মো. আমির হামজার ছেলে আসাদুজ্জামান সরকারি কর্মকর্তা। তিনি খুলনা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন। ছেলের তদবিরে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ও নামহীন পিতাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Bangladesh West Bengal literature prize)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours