মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও লেকচারার, আহমেদাবাদ:

গত  কয়েকদিন সংবাদমাধ্যমের দৌলতে একটা খবর সবার চোখেই পড়েছে মনে হয় –প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং ব্রিটিশ প্রেসিডেন্ট বরিস জনসন আমেদাবাদে এসেছেন। কখনও তাঁরা সবরমতী আশ্রম দেখতে যাচ্ছেন কখনওবা বিশাল পথসভায় অংশ নিচ্ছেন। এখন তাপমান বিয়াল্লিশ থেকে তেতাল্লিশ ডিগ্রী চলছে তবু ও উনাদের একবার চোখের দেখা দেখতে রাস্তায় মানুষের ঢল কিন্তু বেশ ভালোই। তা দুদিন আগে এত রোদেও বাধ্য হয়েই বেরিয়েছিলাম ডাক্তার দেখাতে, খানিক গিয়ে গাড়ী পড়ল যানজটে, চারিদিকে লোক গিজগিজ করছে। ভাবলাম এত মানুষ কি চলেছে মোদীজীর ভাষণ শুনতে না ফর্সা টুকটুকে বরিসবাবু কে দেখতে? লোকগুলোর পোশাক আশাক বলছে এরা গ্রামের মানুষ। এই গরমে অধিকাংশেরই পা খালি, জুতোর বালাই নেই। এই দাবদাহে কিসের আশায় সব ছুটছে?

এসি গাড়ীতে বসেও যেখানে গায়ে ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে সেখানে বাচ্ছা বুড়ো মহিলা পুরুষ মিলে শয়ে শয়ে লোক চলেছে ---না আছে মাথায় ছাতা, না আছে পায়ে জুতো।

ভুল ভাঙ্গাল আমার ড্রাইভার বিক্রম, ভিড়ের দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, ”এরা বাগরী ভাবী, এরা প্রতি বছর এই চৈত্র মাসে বিষনগরের কাছে ওদের কুলদেবীর মন্দিরে পায়ে হেঁটে যায়। দল বেঁধে সব আসছে,---কোনও দল আসছে বরোদা থেকে, কোনও দল আসছে সুরিন্দ্রনগর থেকে কেউ বা সুরাট থেকে। প্রায় আড়াইশো থেকে তিনশ কিমি পায়ে হেঁটে অতিক্রম করছে। ওই দেখুন বিশ পঁচিশ কিমি পর পর স্বেচ্ছাসেবক দল সামিয়ানা খাটিয়েছে। বুড়োরা বাচ্ছা কোলে মহিলারা বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, চায়ে নাস্তা খাওয়াচ্ছে। অনেক দল তো সারা রাত চলছে।“

সত্যিই গাড়ীর কাঁচ নামিয়ে দেখি বাচ্ছারা মায়ের কোলে বসে সাদা কাগজের প্লেটে পুরি ,ভাজি খাচ্ছে, বুড়োরা লাঠির গায়ে সাদা কাপড় বাঁধা ধ্বজা একহাতে ধরে অন্য হাতে মাটির ভাঁড়ের চায়ে আরাম করে চুমুক দিচ্ছে। বড় গাছের নিচে তিন চারটে মাটির জালা বা মটকা, ওগুলোর গায়ে সাদা ভিজে কাপড় জড়ানো, স্টীলের ডান্ডার মুখে লাগানো ঘটি ডুবিয়ে ঠান্ডা জল খাচ্ছে মেয়ে বউরা।

বিক্রম আমাকে অমন অবাক হয়ে দেখতে দেখে বলে উঠল, ”এরা খুব নীচু জাত, এদের সঙ্গে কেউ কোনও কাজ করে না। এরাই ঘরে এসে পুরোনো কাপড় নিয়ে স্টীলের বাসন দেয়, এদের  নিজের  কোনও জমি জায়গা নেই। দীপাবলীর সময় মাটির প্রদীপ বেচে, মকরসংক্রান্তির সময় মানে উতরানের সময় ঘুড়ি বেচে। তবে অধিকাংশ ছেলেগুলো লুকিয়ে মদ খেয়ে সব পয়সা উড়িয়ে দেয়, তাই এদের অবস্থার কোনও উন্নতি হয় না। তবে এদের ঘরের মাটিও লাগে নবরাত্রির সময় অম্বা মায়ের পুজোতে ।“

বাড়ী ফিরে গুগল সার্চ করে দেখলাম ব্রিটিশ আমলে এদের ক্রিমিনাল ট্রাইব বলে চিহ্নিত করলেও ১৯৫২ তে এই তকমা ঘুঁচেছে। বাগরীরা  গুজরাট, রাজস্থান দুই জায়গারই উপজাতি, এরা আদতে ছিল ব্যবসায়ী।

কিছুতেই এদের দিয়ে চাকরী করাতে পারেনি কেউ--তা সে ব্রিটিশ রাজই হোক কি স্বাধীন ভারতের সরকার। উৎসবের সময় মুর্তি বেচে অন্য সময়  কাজু, কিসমিস আনাজ পাতি কখনও কাপড়  চোপড় বেচাকেনা করেই জীবন যাপন করে। এরা কুলদেবীর কাছে ছাগ বলি দেয়, মাছ নিয়েও  রাস্তার পাশে বসে অনেক বাগরী মহিলা।  নিরামিশাষী গুজরাটী বা রাজস্থানীরা বড় নীচু চোখে দেখে এদের। সমাজে এদের স্থান শূদ্রেরও নিচে, সরকার নাম দিয়েছে দেবীপূজক সম্প্রদায়।

রক্তে এদের ব্যবসা, কখনও কারুর গোলামী করতে না পারায় হয়ত আজ অন্ত্যজ শ্রেণীভুক্ত। তবে এ নিয়ে এদের কোন ক্ষোভও নেই। নিজেদের সমাজেই নিজেরা বিয়ে শাদি করে, বেশ ঢাক ঢোল বাজিয়ে বিয়ে করে। একজনের বিপদে পুরো সমাজ পিছনে এসে দাঁড়ায় ---- রাজনৈতিক নেতারা জানেন এরা ভাল ভোট ব্যাংক তাই বেশি ঘাঁটায় না এই হটরাগী বাগরীদের। 

দারিদ্রের সঙ্গে হয়ত নিত্য লড়াই তবু আত্মাভিমানী বাগরীরা মাথা উঁচু করে বলার ক্ষমতা রাখে আমরা কারুর নোকর নই, মাথা যদি নোয়াতেই হয় তবে তা  নোওয়াই খালি কুল দেবীর কাছেই।

(www.theoffnews.com - Bagri caste)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours