তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

শ্রীচরণারবিন্দেষু,

গুরুদেব! বহুদিন শ্রীচরণ দর্শন করিনি। আমার ওপর হয়তো প্রসন্ন কাব্যলক্ষ্মী হিজ মাস্টার্স ভয়েসের কুকুরের ভয়ে আমায় ত্যাগ করেছেন বহুদিন। কাজেই সাহিত্যের আসর থেকে আমি প্রায় স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছি। আপনার তপস্যায় আমি কখনো উৎপাত করেছি বলে মনে পড়ে না। তাই অবকাশ সত্ত্বেও আমি আপনার দূরে দূরেই থেকেছি। তবু জানি, আমার শ্রদ্ধার শতদল আপনার চরণস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়নি।

আমার কয়েকজন অন্তরঙ্গ সাহিত্যিক ও কবি বন্ধু ‘নাগরিক’ পরিচালনা করছেন। গতবার পূজায় আপনার কিরণস্পর্শে ‘নাগরিক’ আলোকিত হয়ে উঠেছিল, এবারও আমরা সেই সাহসে আপনার দ্বারস্থ হচ্ছি। আপনার যে কোনো লেখা পেলেই ধন্য হব। ভাদ্রের শেষেই পূজা সংখ্যা নাগরিক প্রকাশিত হবে। তার আগেই আপনার লেখনী-প্রসাদ আমরা পাব, আশা রাখি।

আপনার স্বাস্থ্যের কথা আর জিজ্ঞাসা করলাম না। ইতি –

প্রণত

নজরুল ইসলাম।

১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৩৫ রবীন্দ্রনাথ এর উত্তরে নজরুলকে লেখেন,

কল্যাণীয়েষু,

অনেকদিন পর তোমার সাড়া পেয়ে মন খুব খুশি হোল। কিছু দাবী করেছো – তোমার দাবী অস্বীকার করা আমার পক্ষে কঠিন। আমার মুস্কিল এই, পচাঁত্তরে পড়তে তোমার এখনো অনেক দেরি আছে এইজন্য আমার শীর্ণ শক্তি আর জীর্ণ দেহের পরে তোমার দরদ নেই। কোনো মন্ত্রবলে বয়স বদল করতে পারলে তোমার শিক্ষা হতো। কিন্তু মহাভারতের যুগ অনেক দূরে চলে গেছে, এখন দেহে মনে মানব সমাজকে চলতে হয় সায়েন্সের সীমানা বাঁচিয়ে।

অনেকদিন থেকে আমার আয়ুর ক্ষেত্রে ক্লান্তির ছায়া ঘনিয়ে আসছিল, কিছুদিন থেকে তার উপরেও দেহযন্ত্রের বিকলন দেখা দিয়েছে। এখন মূলধন ভেঙে দেহযাত্রা নির্বাহ করতে হচ্ছে – যা ব্যয় হচ্ছে তার আর পূরণ হবার উপায় নেই। তোমার বয়সে লেখা সম্বন্ধে প্রায় দাতাকর্ণ ছিলুম, ছোট বড় সকলকেই অন্তত মুষ্টি ভিক্ষাও দিয়েছি। কলম এখন কৃপণ, স্বভাবদোষে নয়, অভাববশত। ছোটবড় নানা আয়তনের কাগজের পত্রপুট নিয়ে নানা প্রার্থী আমার অঙ্গনে এসে ভিড় করে – তাদের সকলকেই ফেরাতে হলো। অনাবৃষ্টির কুয়োর শেষতলায় অল্প যেটুকু জল জমে ছিল সেটুকু নিঃশেষ হয়ে গেছে। আমি প্রতিজ্ঞা করছি কৃপণের অখ্যাতি শেষ বয়সে স্বীকার করে নিয়ে রিক্ত দানপাত্র হাতে বিদায় নেব। যারা ফিরে যাবে তারা দুয়ো দিয়ে যাবে কিন্তু বৈতরণীর মাঝদরিয়ায় সে ধ্বনি কানে উঠবে না।

আজকাল দেখতে পাই ছোটো ছোটো বিস্তর কাগজের অকস্মাৎ উদ্‌গম হচ্ছে – ফুল ফসলের চেয়ে তাদের কাঁটার প্রাধান্যই বেশি। আমি সেকেলে লোক, বয়সও হয়েছে। সাহিত্যে পরস্পর খোঁচাখুঁচির প্রাদুর্ভাব কেবল দুঃখজনক নয়, আমার কাছে লজ্জাজনক বোধ হয়। এইজন্যে এখনকার ক্ষণসাহিত্যের কাঁচা রাস্তায় যেখানে সেখানে পা বাড়াতে আমার ভয় লাগে। সাবধানে বাছাই করে চলবার সময় নেই, নজর ক্ষীণ হয়েছে; এইজন্যে এইসকল গলিপথ একেবারে এড়িয়ে চলাই আমার পক্ষে নিরাপদ। তুমি তরুণ কবি, এই প্রাচীন কবি তোমার কাছ থেকে আর কিছু না হোক করুণা দাবী করতে পারে। নিষ্কিঞ্চনের কাছে প্রার্থনা করে তাকে লজ্জা দিও না। এই নতুন যুগে যে সব যাত্রী সাহিত্যতীর্থে যাত্রা করবে পাথেয় তাদের নিজের ভিতর থেকেই সংগ্রহ করতে হবে।

শুনেছি বর্ধমান অঞ্চলে তোমার জন্ম। আমরা থাকি তার পাশের জিলায় – কখনো যদি ঐ সীমানা পেরিয়ে আমাদের এদিকে আসতে পারো খুশি হবো। স্বচক্ষে আমার অবস্থাও দেখে যেতে পারবে।

ইতি ১৫ ভাদ্র, ১৩৪২

স্নেহরত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথের এই চিঠি পেয়ে ‘নাগরিক’-এর ওই বার্ষিক সংখ্যাতেই (২য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা, ১৩৪২ সন) ‘তীর্থপথিক’ নামে একটা দীর্ঘ কবিতা লেখেন নজরুল ইসলাম। সেই কবিতার শেষের লাইনগুলো পুরোটা উদ্ধৃত করলাম –

বিজ্ঞান বলে, বলুক, রবির কমিয়া আসিছে আয়ু;

রবি রবে যতদিন এই ক্ষিতি-অপ-তেজ-বায়ু।

মহাশূন্যের বক্ষ জুড়িয়া বিরাজে যে ভাস্কর,

তার আছে ক্ষয়, এত প্রত্যয় করিবে কোন্ সে নর?

চন্দ্র-ও আছে, আছে অসংখ্য তারকা রাতের তরে

তবু দিবসের রবি বিনা মহাশূন্য নাহি সে ভরে।

তুমি রবি, তুমি বহু ঊর্ধ্বের, তোমার সে কাছাকাছি

যাবে কোন্ জন? তোমার কিরণ-প্রসাদ পাইয়া বাঁচি।

তুমি স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বিশ্বের বিস্ময়,

তব গুণ-গানে ভাষা-সুর যেন সব হয়ে যায় লয়।

তুমি স্মরিয়াছ ভক্তেরে তব, এই গৌরবখানি

রাখিব কোথায় ভেবে নাহি পাই, আনন্দে মূক বাণী।

কাব্যলোকের বাণী-বিতানের আমি কেহ নহি আর,

বিদায়ের পথে তুমি দিলে তবু কেন এ আশিস-হার?

প্রার্থনা মোর, যদি আরবার জন্মি এ ধরণীতে,

আসি যেন শুধু গাহন করিতে তোমার কাব্য-গীতে!!

১৯৩৫ সালে লেখা এই কবিতাটি কোন কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়নি। এর মাত্র সাতবছর পরে, ১৯৪২ সালের ১০ই জুলাই নজরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং দ্রুত বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। নজরুল ইসলামের বয়স তখন মাত্র ৪৩ বছর। এরপর জীবনের শেষ ৩৪ বছর এই যৌবনদীপ্ত মুখর কবি নির্বাক হয়ে, দুরারোগ্য স্নায়বিক রোগের শিকার হয়েই অতিবাহিত করেন।

অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা ও প্রণাম নিবেদন করি।

সূত্রঃ নজরুল জীবনী / অরুণকুমার বসু (পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা ২০০০)

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে কি চোখে দেখতেন?

কিংবা নজরুলই বা কি ভাবতেন। মন চাইলেই নজরুল চলে যেতেন শান্তিনিকেতনে। উদ্দেশ্য গুরুদেবের সাক্ষাৎ। মাঝে মাঝে পাগলামীও করতেন খুব বেশি। রবীন্দ্রনাথের স্নেহাধিক্যে অদ্ভূত সব কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে ফেলতেন নজরুল। একদিনের ঘটনা সম্পর্কে নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তীকে নজরুল বলেন, ‘একবার শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম এবং ছিলুমও দিন কয়েক। একদিন দুপুরের পরে কবি বসেছিলেন একা দেহলীর বারান্দায়। বেতের একখানা পিঠ উঁচু চেয়ারে। পায়ের কাছে বসে ওঁর একখানা পা টেনে নিয়েছিলাম কোলের উপর। ইচ্ছে ছিল, একটু টিপে দেব। তারস্বরে কবি চেঁচিয়ে উঠলেন, ওরে, ছাড় ছাড় হাড়গোড় আমার ভেঙে গেল। অপ্রস্তুতের একশেষ। আমি সরে বসেছিলুম। আমার দিকে ফিরে চেয়েছিলেন কবি। চোখ তাঁর পিটপিট করছিল। মুখে মৃদৃ হাসি। বলেছিলেন, ক’খানা গান লিখলে আজ? নাকি খালি চ্যাঁচালেই? মুখ ভাড় করে, মাথা নিচু করে আমি বলেছিলুম, মাঝে মাঝে কী মনে হয়, জানেন?—কী? একটা লাঠির বাড়ি মাথায় মেরে আপনাকে শেষ করে দি?— কেন?—কেন? তাহলে আপনার পাশাপাশি চিরকাল লোকে আমার নাম করবে। আর আমার ছবিও আপনার ছবির পাশে ছাপা হবে।– কী সর্বনাশ! ওরে কে আছিস, শিগগিরিই আয়। এ পাগলের অসাধ্য কিছু নেই। কবির কণ্ঠ একটু উঁচুই হয়েছিল, কয়েকজন এসেও পড়েছিল। তাদেরকে সবিস্তারে কবি আমার কথার ফিরিস্তিও শুনিয়ে দিলেন।’

ছাত্র/ছাত্রীদের গান শেখানোর জন্য নজরুলকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকতে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কোলাহল, হৈ চৈ, করতালিপ্রিয় নজরুল কলকাতা ছেড়ে শান্তিনিকেতনের উদার, শান্ত তপোবনে থাকতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্রনাথের ডাকে সাড়া না দিলেও তাঁর প্রতি নজরুলের ছিল প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধ। আমৃত্যু এই শ্রদ্ধাবোধ অটুট ছিল।

মাঝেমধ্যে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের মধ্যে সাহিত্য বিষয়ে বাদ-প্রতিবাদ, ঝগড়া-বিবাদ যে হয়নি, তা নয়। জেলের মধ্যে কথা প্রসঙ্গে নজরুল নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষ কোনো দিনও কবির কাঙ্গাল নয়, ছিলেন বাল্মীকি, ব্যাস, কালিদাস- রবীন্দ্রনাথের সমতুল্য কেউ নন।’ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নজরুলের এ ধারণা সারাজীবন অটুট ছিল। এ ধরনের উক্তি নজরুল তার গুরুদেব সম্পর্কে অনেক করেছেন। কাজী মোতাহার হোসেনকে ১৯২৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নজরুল লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমাকে প্রায়ই বলতেন, দেখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলির মতো, কিটসের মতো খুব বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে, তুই প্রস্তুত হ।’ বস্তুতপক্ষে এই দুই ইংরেজ কবির মতো নজরুলের পরিণতি ও বিষাদময় পরিণামের কথা ভেবে দার্শনিক কবি রবীন্দ্রনাথ এই ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।

এই ভবিষ্যৎবাণী পরে সঠিক বলে প্রমাণিত হল ১৯৪২ সালে যখন বেতারে সম্প্রচারণে ব্যস্ত ছিলেন, হটাৎ কন্ঠ রোধ হয়ে আসে, জানা যায় তিনি ইনভল্যুশনাল সাইকোসিস" রোগে ভুগছেন।এইখানেই রবীন্দ্রনাথের প্রজ্ঞা ও ঋষি সুলভ পর্যবেক্ষণ ।

(www.theoffnews.com - Rabindranath Tagore Najrul Islam)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours