পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

তার লেখা, তার গান মুগ্ধ করেছিল ছাত্রাবস্থাতেই। সেই গান শুনতে শুনতে বেড়ে ওঠা। সাংবাদিকতায় যোগ দিয়ে সেই ভাল লাগা অন্য মাত্রা পেল। তারা টিভিতে তার সঞ্চালনা বাড়িয়ে দিল সেই সমীহ ভাবটাকে। কবীর সুমনের ভরাট গলায় শিষ্ট বাচনভঙ্গি, তার শব্দচয়ন, তার বাক্য গঠন, সব মিলিয়ে ভাল লাগার একটা কমপ্লিট প্যাকেজ যেন। ঈর্ষাও হতো, আমি কেন এমন করে বলতে পারি না, কেন এত ভাল বলেন ইত্যাদি। 

কিন্তু সেই কবীর সুমন আমাকে হতাশ করেছিলেন আগেই। তার ধর্ম পরিবর্তনের ব্যাপারটা আমি মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। না, তিনি হিন্দু থেকে মুসলিম হয়েছিলেন বলে নয়, এমন একজন মানুষ যে কোনও ধর্মের সঙ্কীর্ণ বেড়াজালে নিজেকে বন্দি করে রাখবেন সেটা আমার ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দ হয়নি। যেমনটা পছন্দ হয়নি তার সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দেওয়াও। তবুও তার ফ্যান ছিলাম আমি। পেশার সূত্রে কলকাতায় ফিরে আসার পরে কবীর সুমন সম্পর্কে আরও অনেক কথাই শুনেছি সহকর্মী বা অন্যান্য স্বনামধন্যদের কাছ থেকে যেগুলি তার গুণের সঙ্গে মেলে না। কিন্তু তবুও তার ফ্যান ছিলাম। ছিলাম বলছি এই কারণে, গতকাল আমার সেই বিবর্ণ মুগ্ধতা পুরোটাই ঘৃণায় বদলে গিয়েছে। সমসাময়িক সংবাদ মাধ্যমের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ইচ্ছাকৃত ভাবেই এখন যোগাযোগ কম রাখি তাই বোধহয় একটু দেরিতেই অডিও ক্লিপিংসটি পেলাম। একজন সাংবাদিকের সঙ্গে কবীর সুমনের কথোপকথন। অতি কদর্য অশ্লীল ভাষায়, নিন্দনীয় ভঙ্গীতে তিনি সেই সাংবাদিকের চ্যানেল রিপাবলিক বাংলাকে আক্রমণ করেছেন। আরএসএস'এর দালাল বলেছেন। যে সুমনের ভাষাচয়ন আমাকে এক সময় মুগ্ধ করেছে, ঈর্ষান্বিত করেছে, সেই সুমনের ভাষা শুনে স্তম্ভিত আমি। না, তিনি গালাগাল দেন সেটা আমি আগেই শুনেছি। কিন্তু একজন সাংবাদিকের প্রতি একজন শিল্পী, একজন প্রাক্তণ সাংবাদিকের যে এমন ভাষা হতে পারে তা না শুনলে হয় তো আমিও বিশ্বাস করতাম না। 

আমি ওই সাংবাদিককে চিনি না। রিপাবলিক বাংলা টিভি চ্যানেল আমারও পছন্দের নয়। তাদের সংবাদ পরিবেশনের ধরণ, তাদের সঞ্চালকদের চিৎকার করে সঞ্চালনা করা, অকারণ খবরের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করা এগুলি ব্যক্তিগত ভাবে আমার বেজায় অপছন্দের। আমি ওই চ্যানেল সচরাচর দেখিও না। সে তো অনেকেই অনেক চ্যানেল পছন্দ করেন বা করেন না। কিন্তু তাই বলে তার সাংবাদিক একটি সাধারণ অরাজনৈতিক কারণে ফোন করলে তাকে ওই ভাষায় গালাগাল দিয়ে ফোন রেখে দেওয়ার কথাও কি বলা যায়? তিনি ওই চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি নন, এটা কি ভব্য ভাবে বলা যেত না? মনটা খারাপ করে দিলেন সুমন আপনি।

সকাল থেকেই সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড়। কবীর সুমনের এই বক্তব্যের নিন্দায় সরব সকলেই। কিন্তু তারা প্রায় সকলেই সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি। এই অডিও ক্লিপ কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যেও ঘুরছে। আমারই স্কুল জীবনের বন্ধুদের হোয়াটস এপ গ্রুপে একজন বন্ধুও এই ক্লিপটি পোস্ট করেছে দেখলাম। অর্থাৎ সাধারণ মানুষও গতকাল থেকে সুমনের এই বাক্যবাণী শুনেছেন। কিন্তু তাদের তরফে প্রতিবাদ কই? আসলে সাংবাদিকদের অবস্থা এখন অনেকটা পুলিশের মত হয়ে গিয়েছে। সাধারণ মানুষ পুলিশকে দেখলে নত হয় ভয়ে - অস্বস্তিতে, শ্রদ্ধা বা ভালবাসায় নয়। সাংবাদিকদের প্রতিও এখন দেখি সাধারণ মানুষের বেজায় রাগ। তারা সুযোগ পেলেই প্রকাশ্যে সেই রাগ উগরেও দেন অবিরত। সংবাদ মাধ্যম তথা সাংবাদিকদের প্রতি সাধারণ মানুষের আগেকার সেই সমীহ ভাব, সেই শ্রদ্ধাবোধ এখন উধাও। তাই সাংবাদিক গালাগাল খেলেও সাধারণ মানুষ হয়তো মাস্কের আড়ালে মুচকিই হাসেন। এক্ষেত্রে কিন্তু আধুনিক সাংবাদিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। এখন  প্রচুর সংবাদ মাধ্যম। তাদের আচরণ, তাদের শিক্ষা, তাদের রুচিবোধ এসবই প্রকাশ পায় তাদের কাজের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেটাই এখন অনেক ক্লিশে হয়ে গিয়েছে। সাধারণ খবরকে জনপ্রিয় করতে গিয়ে অকারণ উত্তেজনার মোড়ক দেওয়া, উত্তেজনা বোঝাতে গিয়ে নিজেরাই অত্যধিক উত্তেজিত হয়ে পড়া, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা কমিয়ে দেওয়া , এ সবই ছাপ ফেলে তাদের কাজে, ছাপ ফেলে জনমানসেও। অধিক সন্ন্যাসীতে কি গাজন নষ্ট হওয়ার দশা বর্তমান সংবাদ মাধ্যমে? এ প্রশ্ন এখন বার বার ফিরে আসছে সংবাদ মাধ্যমের দিকে। তাই তো সংবাদ মাধ্যম আক্রান্ত হলে, তাদের প্রতি নিন্দনীয় ভাষা প্রয়োগ হলে এখন সাধারণ মানুষ আর গর্জে ওঠেন না।

ভাবার কথা, অবশ্যই ভেবে দেখার কথা। কিন্তু তাই বলে কবীর সুমনের এই কীর্তিকে মেনে নেওয়া যায় না। সংবাদ মাধ্যমের নানা দোষ ত্রুটি আছে, তাদের পক্ষপাতদুষ্টতাও চোখে লাগে বড্ড। কিন্তু তাই বলে ওই ভাষায় গালাগালি দেওয়া? না সুমন, আপনাকে আর শিল্পী বলে ভাবতে পারছি না। অনেকেই বলেন কাজের সঙ্গে শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবনকে মেলানো ঠিক নয়। কিন্তু একজন শিল্পী তার কাজের জন্যই অনেকের কাছে আদর্শ হন, তার ব্যক্তিগত জীবনেও সেই আদর্শের ছাপ থাকা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। আমার সঙ্গে অনেকেই একমত না হতেই পারেন কিন্তু এটা আমার ব্যক্তিগত মত। সেখান থেকেই সুমনের মুখে মা মাসিকে উল্লেখ করে দেওয়া ওই গালাগাল শুনে আমি আর “তোমাকে চাই” বলতে পারছি না। কিছুতেই না।

(www theoffnews.com - Suman Chattopadhyay singer slang words)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours