দেবিকা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও লেকচারার, চন্দননগর, হুগলি:
তারানাথ আচার্য হিসেবে কালনা সহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা তাঁর ছাত্র সমাজের ভরণ পোষণের তাগিদে এবং আমাদের দেশের গ্রামে গঞ্জে থাকা মানুষের কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে তাঁর সম্পদকে নিজের বিলাসে না লাগিয়ে কাপড়ের ব্যবসা, কাশ্মীরি শালের ব্যবসা, কাঠের ব্যবসা, ধান চালের ব্যবসা শুরু করেন। বিলেতি সুতো কিনে কালনার প্রায় বারশো তাঁতী এবং মেদিনীপুরের তাঁতীদের দিয়ে কাপড় বুনিয়ে কাশী, মির্জাপুর, কানপুর, মথুরা, গোয়ালিয়রে পাঠাতেন গরুর গাড়িতে করে। মেদিনীপুরের রাধানগর গ্রামে তাঁত বসিয়ে কারখানা তৈরি করেন। নেপাল থেকে শালকাঠ এনে কলকাতা বড়বাজারে, কালনাতে বিক্রি করতেন। কালনায় ঢেঁকি বসিয়ে ধান থেকে চাল তৈরির ব্যবস্থাও করেন। বীরভূমে সোনার দোকানের পাশাপাশি ঘি তৈরির কারখানা, পাঁচশো গরু নিয়ে গো-খামার তৈরি করেছিলেন। উৎপাদিত ঘি কলকাতাতে বিক্রি করতেন। কালনার জমিতে আনাজ ফলিয়ে সেসব নিয়ে পোস্তার বাজারে বিক্রি করতেন। তখন কালনা-কলকাতা জলপথে যোগাযোগ। এতকিছুর মধ্যেও তিনি কিন্তু নিয়মিত পড়াশোনার চর্চাটি বন্ধ করেননি।
১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে অম্বিকা-কালনা ধন্য হয়েছিল বিদ্যাসাগরের পদধূলিতে। শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের তথ্য অনুযায়ী সেদিন ছিল ডিসেম্বর মাসের শনিবার। সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের অধ্যাপক নিযুক্ত করার জন্য তারানাথের মতো যোগ্য ব্যক্তি আর কেউ নেই বলে মনে হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্রের। ঈশ্বরচন্দ্রের সিদ্ধান্তকে নির্ভুল প্রমাণ করে তারানাথ ১৮৪৫ থেকে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে অধ্যাপনা করেন। ১৮৭৩ থেকে ১৮৮৪ পর্যন্ত সময় কালের মধ্যে 'বাচস্পত্যাভিধান'এর বাইশটি খণ্ড প্রকাশ করেন।এছাড়া 'শব্দস্তোমমহানিধি' নামে পাঁচ খণ্ডের অভিধান, সংস্কৃত শাস্ত্রের টীকা, পাণিনির ব্যাকরণের টীকাও তিনি প্রস্তুত করেন। বিনা পারিশ্রমিকে কালীপ্রসন্ন সিংহকে তাঁর মহাভারত অনুবাদের সময় সাহায্য করেছিলেন। ভারবি রচিত 'কিরাতার্জ্জুনীয়ম্', মাঘ রচিত 'শিশুপালবধ' ছাপার আকারে পাওয়া যেত না, কাব্য দুখানি সম্পাদনা করে ছাপানোর ব্যবস্থা করেন তারানাথ তর্কবাচস্পতি। মল্লিনাথের টীকা ব্যতীত অনেক গ্রন্থ বোঝা বা বোঝানো দুরূহ হোত। সেসব কাশী থেকে আনিয়ে ছিলেন এই তারানাথ। তাঁর সুযোগ্য পুত্র জীবানন্দ বিদ্যাসাগরও বহু গ্রন্থের টীকা প্রস্তুত করেন।
তারানাথ কলকাতায় তৈরি করেন 'ফ্রি সংস্কৃত কলেজ'। নারীশিক্ষা থেকে বিধবা বিবাহ, এমন বহু কর্মকাণ্ডে যুক্ত থেকেছেন তিনি। মেয়ে জ্ঞানদাদেবীকে বেথুন স্কুলে ভর্তি করেন। বিধবা বিবাহের পক্ষে যুক্তি সাজাতে বিদ্যাসাগর তারানাথের পরামর্শ নেন এবং প্রস্তাবে দ্বিতীয় স্বাক্ষরটি ছিল তারানাথের। সমাজে প্রথম বিধবা বিবাহ দেওয়া হলে তারানাথ তাঁর স্ত্রীকে দিয়ে নবদম্পতিকে বরণ করার ব্যবস্থা পর্যন্ত করান।
শুধু একটি বিষয়, বহুবিবাহ প্রথা উচিত না অনুচিত, এ নিয়ে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তারানাথের মতান্তর মনান্তরে পৌঁছায়। ১৮৭১খ্রিস্টাব্দের জুলাইয়ে বিদ্যাসাগর 'বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার' নামে প্রথম পুস্তিকাটি প্রকাশ করার পর তারানাথ ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে 'বহুবিবাহবাদ'নামে একটি সংস্কৃত পুস্তিকায় প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, বহুবিবাহ শাস্ত্র সম্মত। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর একই নামে দ্বিতীয় পুস্তিকায় বহুবিবাহ সমর্থনকারীদের বিশেষ করে তারানাথের তীব্র নিন্দা এবং সমালোচনা করেন। 'কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য' ছদ্মনামের আড়ালে হাস্যরসের ছলে 'অতিঅল্প হইল', 'আবার অতি অল্প হইল', 'ব্রজবিলাস' রচনাগুলিতে বাংলাভাষাকে অবলম্বন করে যুদ্ধে নামেন, যাতে সংস্কৃত না জানলেও সাধারণ শিক্ষিত মানুষ বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে পারেন।
"অতি দর্পে লঙ্কাপতি সবংশে নিপাত।
অতি দর্পে বাচস্পতি তব অধঃপাত।।"—এর উত্তরে তারানাথ প্রায় নীরব ছিলেন, শুধু বলেছিলেন, "যে ব্যক্তি ভাইপোস্য এইমত অশুদ্ধ প্রয়োগ করে তাহার উত্তর দেওয়া উচিত ছিল না।" বহুবিবাহকে কেন্দ্র করে বিদ্যাসাগর তারানাথের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন কিনা সে আলোচনায় না গিয়ে বিদ্যাসাগরের যে ভাবমূর্তি আমাদের মনে রয়েছে তা অক্ষুণ্ণ রাখতে আমরা চেষ্টা করব। এটা ঠিক এই একটি মাত্র কারণে দুই বন্ধুর মধ্যে বিচ্ছেদের প্রাচীর নির্মিত হয়।
যাগযজ্ঞ, ফলিত জ্যোতিষে তারানাথের বিশ্বাস ছিল। একদল হিন্দু যখন কলকাতায় চালু হওয়া নতুন কলের জলে শালগ্রাম শিলার পুজো করে, তখনই (১৮৭১) তিনি কলকাতা 'ধর্মসভা' থেকে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করেন। 'আর্যাবর্ত রীতি সংস্থাপনী সভা'র সক্রিয় প্রচারক হিসেবে সারা বাংলায় আর্য ধর্ম প্রচার করতে থাকেন কলকাতা থেকে বেনারসে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত অর্থাৎ ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত।
পরবর্তীকালে তারানাথের পুত্র জীবানন্দ বিদ্যাসাগরের উত্তরসূরীদের পক্ষে কালনার শ্যামরায় পাড়ার বাড়ি, সম্পত্তি সব রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। তারানাথের বংশের দুর্গোৎসব রক্ষা পেয়েছে শ্যামরায় পাড়ার বারোয়ারী কমিটির হাতে। ভিটে মাটি কিছু বিক্রিত, কিছু ভগ্নপ্রায়।
আমরা বলি, কীর্তির্যস্য স জীবতি। ক্ষমতাপন্ন লোক নিজের কীর্তির মধ্যেই নিজে বেঁচে থাকেন। শিক্ষাক্ষেত্রে এবং সামাজিক একাধিক কর্ম কাণ্ডে তারানাথ তর্কবাচস্পতির অবদানের কথা তো হঠাৎই মুছে যাওয়ার নয়! তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে কালনায় একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে ।অনুসন্ধিৎসু মন আরও কিছু খুঁজতে চায়।কলকাতায় তাঁর নাম অপরিচিত,কাশীর অলিতে গলিতে খোঁজ করে কোথাও তাঁর নামের চিহ্ন মেলেনি।
তবু কালনার মানুষের মনে বেঁচে থাক তারানাথ তর্কবাচস্পতি। আমরা যেন উপলব্ধি করতে পারি আমাদের সমাজের প্রাচীন পণ্ডিত ব্যক্তিরা কেবল 'সজীব শাস্ত্রের শ্লোক' ছিলেন না, তাঁদের মধ্যে ভালোমন্দের সংঘাত ছিল, বিচার ছিল, বিদ্রোহ ছিল, মতবৈচিত্র্য ছিল, এককথায় জীবন ছিল।তাঁদের চিন্তা, কাজ, উদ্ভাবনী শক্তিকে অনুসরণ করলে, মননে স্মরণে স্থান দিলে প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হবে। (সমাপ্ত)
ঋণস্বীকারঃ তারাসাধন ভট্টাচার্য (আমার বাবা) ও ত্রিদিবসন্তপা কুণ্ডু
(www.theoffnews.com - Taranath TarkaBachaspati)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours