চন্দ্রিমা দত্ত (সাঁজবাতি), লেখিকা ও শিক্ষিকা, শ্রীরামপুর, হুগলি:

বলছিলাম মানবজমিনে সুরের অদৃশ্য চিরন্তনী বন্ধনের কথা। বলছিলাম পদাবলী কীর্তন টপ্পা বিভাস ইত্যাদির কথা। গ্রামে একসময় প্রচুর টপ্পা গানের প্রচলন ছিল। প্রসিদ্ধ কবি (কথক) শ্রীধর ভট্টাচার্য্য ছিলেন উত্তম টপ্পা রচয়িতা। কিন্তু এর সাথে নগরেরও যোগ রয়েছে বৈকি! তাঁরা তো সবসময় নাগরিক জীবনকেও তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, প্রভাবিতও হয়েছেন! ঐ যে বলেছিলাম - মানুষের স্বভাবই হলো মনের মতন হলেই তাকে কোনো না কোনো ভাবে গ্রহণ করা! তাই কতকগুলো রীতিকে একরকম মনে হলেই বোঝা যাবে একে অপরের ওপর সুপ্রভাবান্বিত হয়েছে।

ভাটিয়ালি গানে একপ্রকার তান আছে যা একান্তই তাদের নিজস্ব তান। সেটা রাগসঙ্গীত বা টপ্পার অনুকরণ না। গায়কের অন্তর থেকে উৎসারিত আপনিই। "বাউলদের গানে রাগসঙ্গীতের সাদৃশ্য থাকলেও তা স্বতন্ত্র ভাবে বাউলদের নিজস্ব সৃষ্টি" (রাজ্যেশ্বর মিত্র)

আমি এবার কতগুলো পদের অদ্ভুত সাদৃশ্য উল্লেখ করবো - কিন্তু সবাই আশ্চর্যজনক ভাবেই স্বতন্ত্র। আসলে মানবজমিনের আবাদে তো বারবার ঘুরে ফিরেই একই ফসল আসে, আসবে! সৃষ্টি তো আত্মার বন্দনা, তাই না? যেমন ঝুমুর, ভাদু, টুসু, ভাটিয়ালি, বাউল, ভাওয়াইয়া জারি, গম্ভীরা গানে অনেক অনেক বৈষ্ণব পদাবলী ও শাক্ত পদাবলীর আংশিক ছত্র বা শব্দ পাওয়া যায়। যাকে বলে সাংস্কৃতিক আন্তর্বয়ন আর কি! 

বিখ্যাত বাংলা টপ্পা "আমার কাঁচা পিরিত পাড়ার লোকে পাকতে দিল না " এবং নীলকন্ঠ রচিত পদ "তোমায় হেরে অঙ্গ জ্বলে" গান দুটির কথার সাদৃশ্য লক্ষণীয়। 

বৈষ্ণব পদ - "দারা পুত্র বধূ যতন করিছে 

সকলি নিমের তিতা

মরণ সময়ে হাতে গলে বান্ধি 

মুখে জ্বালি দিব চিতা।।

বদন ভরিয়া হরি না বলিয়া 

শমন তরিবে কিসে।" (লোচন দাস)

আবার, হরু ঠাকুর বলেছেন -

"হরি বোল্ বলিয়ে প্রাণো যাবে 

আমার এমন দিন কি হবে।।

অন্তিম সময়ে বন্ধুগনে 

আমার শ্রবণে হরিনাম শুনাবে" 

তার মানে উপরিউক্ত পদ দুটির সারমর্ম কিন্তু একই! 

হরিনাম থেকে অলস কোরো না রসনা! 

এবার সেই একই সারকথার কিছু পদ উল্লেখ করছি "ভাই বন্ধু দারা পুত্র কাঁদে তারা দুদিন মাত্র,

তোমার ধনে হয়ে মত্ত তোমায় ভুলে যাবে রে।

আসছ একা যাবে একা কেবলমাত্র পথের দেখা ‌

অন্তিমকালে হরি সখা দাস পিতাম্বর ভাবে রে।" 

(পুরুলিয়া) 

" ... তখন ভাই দারা সুত

সবাই ছিল আমার বশে 

এখন ধন উপার্জন, না হইল দশার শেষে " (রামপ্রসাদ সেন)

"যারে ধরে পাবি নিস্তার 

তারে সদাই ভাবিলে পর,

সিরাজসাঁই কয় লালন তোমার 

যাবে ভবের কুটুম্বিতে।। (লালন ফকির)

"কেবল আশা , ভবে আসা 

আশা মাত্র হলো।...

এখন সন্ধ্যেবেলায় কোলের ছেলে

ঘরে ফিরে চলো।।" (রামপ্রসাদ সেন)

আমি সমুদ্রের মাত্র একবিন্দু জলকণাকে এখানে তুলে ধরলাম। চেষ্টা করলাম এটাই বলতে যে মানবজমিনের আবাদে একই মূল্যবান শস্যকণা বারবার বিভিন্ন রূপে এসেছে। এই কৃষিকাজ লোকমানসের সম্বল এবং প্রাপ্তিতে ভরপুর চিরকাল। এই লেখা পরবর্তীতে আবার অন্য এক বিন্দু ধরে এগোবার চেষ্টা করবে। (সমাপ্ত)

(www.theoffnews.com - Indian songs Bengali Songs)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours