তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

১৯০৫ সাল। যুবকের নাম রবীন্দ্রনাথ। স্থান জগন্নাথ ঘাট। রবিঠাকুরের সঙ্গীরা হলেন অবণীঠাকুর, দীনুঠাকুর প্রমুখ। এখান থেকেই রবীন্দ্রনাথ লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রাখিবন্ধন উৎসব শুরু করেছিলেন। রাস্তার দু’পাশে, বাড়ির ছাদে, গাড়ি বারান্দায় লোকে লোকারণ্য। মহিলারা খই আর ফুল ছড়াচ্ছিলেন। স্নান করে উঠে, একে অপরকে রাখি পরিয়ে তাঁরা পথঘাটের লোকজনদের তো বটেই, রবিঠাকুর কাছের আস্তাবলের মুসলমান সহিসদের, নাখোদা মসজিদের মৌলবিদেরও রাখি পরিয়েছিলেন। এই জগন্নাথ ঘাট তখন থেকেই যেন পুণ্যস্থান হয়ে আছে। আদতে এটি শোভারাম বসাকদের ঘাট। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করে প্রচুর মুনাফা করে এই ঘাট প্রতিষ্ঠা করেন শোভারাম। তারপর তাঁদের গৃহদেবতা জগন্নাথদেবের নামে ঘাটের নামকরণ করেন। কেউ কেউ বলেন, জগন্নাথ ঘাট একটু এগিয়ে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে ঘাটে এসেছিলেন সেটিই জগন্নাথ ঘাট, যেখান থেকে জোড়াসাঁকো ও মসজিদ, দু’টিই কাছে।

এটি বহু প্রাচীন ঘাট। ১৭৮৪ সালের সরকারি ম্যাপে এর উল্লেখ আছে। তবে নামকরণের ব্যাপারে বিতর্কও আছে। এটি পাথরের তৈরি ঘাট। দূর থেকে বড় বড় নৌকায় করে পাথর এনে এই ঘাটে ফেলা হয়েছিল। তার থেকে কিছু পাথর এখানে লাগিয়ে বাকি পাথর অন্য কাজে লাগানো হয়েছিল। কথিত যে, বাকি পাথরগুলো রেলওয়ে তৈরির কাজে লাগানো হয়। রেল কোম্পানির প্রতিষ্ঠা ১৮৪৪ সালে। আমাদের এখানে প্রথম ট্রেন চলেছিল ১৫ অগস্ট, ১৮৫৪। আর এই ঘাটের কথা, আগেই বলা আছে, ১৭৮৪ সালের ম্যাপে আছে। পাথর রেলপথ তৈরিতে লাগতেই পারে, ৬০-৭০ বছর বিনা নামকরণে এই ঘাট পড়ে ছিল, সেটা ভাবা যাচ্ছে না।

এ বার যে ঘাটে রবীন্দ্রনাথ চিরদিনের জন্যে রয়ে গিয়েছেন, সেই নিমতলা ঘাটের কথা বলি। দীনবন্ধু মিত্রের কলমে ‘নিমতলা সমাধি শ্মশান’ সব দিন সব রাত জেগে থাকে। ১৯৪১-এর ৮ অগস্ট রবিঠাকুরের শেষযাত্রা এখানে এসে থেমেছিল। ঘাটে সেদিন যখন রবীন্দ্রনাথের শেষকৃত্য চলছিল, তখন উল্টোদিক থেকে দেখার জন্যে সার সার নৌকায় বহু লোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। আবার ঘাটের সীমানা ধরে রেলওয়ে ভ্যান, মোটরগাড়ি, পিছনের বড় বড় গাছ, দূরের বাড়ির ছাদ— সব লোকে লোকারণ্য ছিল।

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর অ্যালেন গিনসবার্গের এই ঘাট খুবই প্রিয় ছিল। এখানে তাঁরা সাধু, ভিখারি ও অন্যান্য আরও নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে অনেক রাত কাটিয়েছেন। শুধু রবিঠাকুর নন, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত এই ঘাট এখন ‘ভূতনাথ মন্দির’ এর জন্যে বিখ্যাত।

তবে এই নামকরণের  বিতর্ক এইখানেই শেষ নয়। এই সন্ধান আজও চলছে। কেউ কেউ বলেন, নিমগাছ নয় বরং নিয়ামৎতুল্লাহ মসজিদের নামেই নামকরণ ‘পুণ্যক্ষেত্র’ নিমতলার? কলকাতার পুরনো অঞ্চলগুলির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে অজান্তেই ছায়া পড়ে ইতিহাসের। সেখানে কত নাম, কত কাহিনী। কে জানে, তার কোনটা ঠিক! কত কাহিনীর পাতা হলুদ হয়ে জমে আছে কোনো গোপন কোণে। 

হুগলি নদীর পশ্চিম তীরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটি শ্মশান। শুধু শ্মশান নয়, মহাশ্মশান। এবং সে-কারণে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর কাছে নিমতলা  আজও পুণ্যক্ষেত্রও বটে। এই শ্মশানেই বিলীন হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নশ্বর দেহ। তালিকাটি বেশ দীর্ঘই। খ্যাত-অখ্যাত মানুষের শেষ মুহূর্তের আয়না এই শ্মশান ও তৎসংলগ্ন ঘাট। কথায় বলে, নামকরণের মধ্যে লুকিয়ে থাকে ইতিহাসের একটা চিহ্ন। তাকে খুঁজে বের করাই ঐতিহাসিক ও গবেষকদের কাজ। হয়তো নতুন কোনো পরত খুলে আসে! সেই একই পথ ধরে এসে পড়ে নিমতলার নাম-মাহাত্ম্য।

নানা কিংবদন্তি রয়েছে এই নাম ঘিরে। বলা হয়, শ্মশান ঘাটের ধারের এক বিশাল নিমগাছ থেকেই নাকি এই অঞ্চলের নামকরণ। অনেক বইতেও এই কাহিনীটির উল্লেখ আছে। কোথায় সেই গাছ? সে কি এখনও শ্বাস নিচ্ছে? দেখে নিচ্ছে তার পুরনো আত্মাকে? জানা যায় না। বরং চোখ ফেরানো যেতে পারে দুটি স্থাপত্যের দিকে। দুটোই ধর্মস্থান। শ্মশানের আগে চলে গেছে চক্ররেলের লাইন। তার আগেই নিমতলার বিখ্যাত আনন্দময়ী কালী মন্দির। লাল রঙের মন্দিরটির ভেতরের বিগ্রহটি আদতে শ্মশানকালী। শ্মশান থেকে দূরে কালীর মন্দির? শুনতে খানিক অবাকই লাগে। একটু আগেই বলছিলাম দুটো ধর্মস্থানের কথা। একটির কথা তো বলা হল। দ্বিতীয়টির সঙ্গেও জুড়ে আছে নিমতলার নাম-মাহাত্ম্য। আনন্দময়ী কালী মন্দিরের আগেই আপনার নজর টানবে একটি মসজিদ। নাম নিয়ামৎতুল্লাহ মসজিদ। শাহ নেয়ামত উল্লাহ ওয়ালীর সমাধি মুঘল যুগের সর্বপ্রথম সমাধি স্থাপত্য নিদর্শন বলে বিবেচনা করা হয়। এটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর তালিকাভুক্ত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা।

১৭৮৪ সালে এই অঞ্চলের জমিদার ছিলেন মহম্মদ রমজান আলি। নিজের পূর্বপুরুষের নামে এখানেই এই মসজিদটি তৈরি করেন। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা মিথ। স্থানীয়রা বলেন, মসজিদের তলায় নাকি গোপন সুড়ঙ্গ গঙ্গার ঘাট অবধি চলে গেছে। নিয়ামৎতুল্লাহ আর নিমতলা— অনেকটা অপভ্রংশ হয়ে আসা শব্দ মনে হচ্ছে না? তাহলে কি নামকরণের পেছনে রয়েছে এই মসজিদটি? প্রশ্ন আসে…।

অবশ্য সম্প্রীতির নানা উদাহরণ তৈরি করেছে এই বিশেষ মসজিদটি। এখানকার সমস্ত ধর্মের সব মানুষের কাছে ‘আমাদের’ মন্দির, ‘আমাদের’ মসজিদ। আমরা-ওরা বিভেদে না গিয়ে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত মিনার। অবশ্য এই প্রথা চলে আসছে মহম্মদ রমজান আলির সময় থেকেই। একটা সময় ঘাটে নাকি হিন্দু মুসলিম একসঙ্গে স্নান করতেন। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এ বড়ো সুখস্মৃতি।

প্রয়াত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের প্রপৌত্র, রাজপরিবারের শেষ বংশধরকে হারাল কলকাতা নিমগাছ না নিয়ামৎতুল্লাহ? বিতর্ক থেকেই যাবে। দেখতে দেখতে বিকেলের ছায়া পড়বে ঘাটে। অস্থি ভাসিয়ে কেউ উঠে আসবেন ভেজা কাপড়ে। তখনই হয়ত বেজে উঠবে আজান ধ্বনি; কিংবা মন্দির থেকে ভেসে আসবে ধূপের গন্ধ। কলকাতার বুকেও যেন আলো পড়ল একটু। পরক্ষণেই লুকিয়ে ঢুকে গেল গর্তে। তাকে ধরার জন্যই তো এত অভিযান!

শেষ বিচারে বলি জন্ম ও মৃত্যুর সময় বা মৃত্যুর পরে কেউ হিন্দু নন আর কেউ মুসলিম নন। জন্মের পরে কোনো শিশু না বোঝে জাত না বোঝে জাত ও ধর্ম। শিশু ধর্ম বোঝে না, দল বোঝে না, এমন কি ঈশ্বর ও বোঝে না

আসলে সেই হলো না বোঝা মানব ঈশ্বরের সারসংক্ষেপ। আজ হিন্দু মুসলিম অসম্পৃতির সময়ে বলতে আবার  বাধ্য হচ্ছি, সবার ওপরে মানুষ সত্য (ধর্ম নয়) তাঁহার ওপরে কেউ নয়। এই কথা বহু যুগ ধরে বলেছেন, গৌতম বুদ্ধ, তুলসিদাস, সন্ত কবীর, চৈতন্য, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ ও বিদ্যাসাগর,অবশ্য এই সব নামের মধ্যেও অনেক ফকির মুসলিম সন্ন্যাসীর নাম ও আছে। কিন্তু আজ আমরা অনেকেই ভুলতে বসেছি। (সমাপ্ত)

তথ্যঋণঃ

কলিকাতার পথে পথে / সন্দীপ চক্রবর্তী

কলিকাতার সমাজ ও সংস্কৃতিতে / অজিত বসু।

(www.theoffnews.com - Kolkata Nimtala Ghat Street)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours