সুস্মিতা পাল, লেখিকা ও শিক্ষিকা, কলকাতা:

বিশালতা আর দুর্গমতার হাতছানি এড়ানো খুব সহজ নয়। চার বছর বয়সে উত্তর ভারত বেড়াতে গিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে অনেক ঘুরেছি। কিন্তু সময়টা শীতকাল ছিল না, তাই বরফ জোটেনি ভাগ্যে।তারপর সিনেমায় যখনই দেখতাম বরফ মোড়া সাদা পাহাড়, মনটা আঁকুপাঁকু করত। আমাদের বড় হয়ে ওঠার সময়টায় সিনেমা আজকের মতো বাস্তব ঘেঁষা ছিল না। রোমান্টিক গান মানেই সঙ্গে উপরি পাওনা বরফ ঢাকা পাহাড়ে মানসভ্রমণ। তারপর সেও চাক্ষুষ করা হলো, বরফে গড়াগড়ি, স্নোবল ছোঁড়াছুঁড়ি --বাদ গেল না কিছুই। নতুন পরিচয়ের সময় বিস্ময়ের প্রাবল্যটাই বেশী থাকে, মন তার সবটুকু মনোযোগ উজাড় করে দেয় যাতে একবিন্দুও ফাঁক না থাকে। তারপর রয়ে যায় মুগ্ধতা, গাঢ় থেকে প্রগাঢ় হতে থাকে।

গাঢ়োয়ালী প্রকৃতির আনাচকানাচে উঁকি দিতে দিতে সারাদিন কেটে গেল মুন্সীয়ারী যাওয়ার পথে। উচ্ছল বৃতি ফলস প্রাকৃতিক কারণে এখন রাস্তা থেকে কিছুটা সরে গেছে। অনবরত ট্যুরিস্টদের কৌতূহলী নজর থেকে যেন আড়াল খুঁজে নিয়েছে। পাহাড় যতই ভালোবাসি না কেন সে আমায় বড্ড ভোগায়। যাদের মোশন সিকনেস আছে তারা বুঝবেন আমার কষ্ট। প্রতিবার ওষুধপত্র চলতে থাকে কিন্তু যেই না গাড়ির চাকা ঘুরতে শুরু করল, আমারও মাথা ঘোরা আরম্ভ হলো। কোনোদিন জার্নি এনজয় করতে পারি না ভালো করে। মুন্সিয়ারীর পথে সুয্যিমামা তো পাটে বসলেন, অন্ধকারে গাড়ি এগোতে থাকল আর সাদা বরফ আশপাশ থেকে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল।

গাড়ির চাকা স্কিড করতে চাইছে বারবার, উত্তেজনায় শারীরিক অস্বস্তিও ভুলে গেছি তখন। জিম করবেট ন্যাশনাল পার্কে অনেক টাকা খরচ করেও তেমন কিছু দেখতে পাইনি-- যদিও সেই দারুণ অভিজ্ঞতা আগে বলেছি, আমি বলতে চাই়ছি বাঘ মামার দর্শন হয়নি। আর এই রাতের অন্ধকার পাহাড়ী পথে গাড়ির হেডলাইটে দেখা গেল এক নেকড়ে দুরন্ত লাফে রাস্তা পার করে রাতের আঁধারে মিলিয়ে গেল। এই দুর্গমতা কোথাও একটা উপলব্ধির জন্ম দেয় - পাহাড়ে নিজের কোনো জোর, কোনো ক্ষমতা খাটে না, সে যদি আমাকে সপ্রাণ ফিরিয়ে দেয় তবেই আমি পারব নিজের চেনা বৃত্তে এসে দাঁড়াতে। জীবনের খাতায় প্রতিটি কণার হিসেব লিখে নিতে। আপাতত বরফ-পিছল পথে গন্তব্যে পৌঁছনোর লড়াইতে ব্যস্ত আমাদের সঙ্গী শুধু কালো আকাশের ছায়াপথে পালিশ করা হিরেকুচির মতো মিটমিটে তারারা। ভয়ঙ্কর সুন্দরের সঙ্গে স্বপ্নের সময়ে সে এক ভাষাহীন মুহূর্ত। যা জন্ম দেয় মনের মধ্যে গরাদহীন কিছু জানালার, আর আমি জানালাগুলো মুঠো খুলে ভাসিয়ে দিই যারা ঘরে বন্দী হয়ে আছে-তাদের। (ক্রমশঃ)

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(http://www.theoffnews.com travel)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours