মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, লেখিকা, খড়গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

'আশ্বিনের ঐ শারদ প্রাতে 

বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর-'

অন্ধকার মাখা ভোরের আকাশে ছড়িয়ে পড়ল সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া কন্ঠস্বর। বাংলার প্রতিটি বাড়িতে তখন উৎসবের আমেজ। বিছানায় ঘুম জড়ানো চোখে শৈশব আর বার্ধক্য পাশাপাশি শুনছে সেই স্বর। বাগানের শিউলিরা টুপটাপ ঝরে পড়ছে আগমনী আনন্দে। ঝরে পড়া যে এত সুখের তা শরৎ না এলে বুঝি জানা যেত না। অরুণ আলোর ছোঁয়ায় যখন উষা লজ্জারুণ হল, তখন রেডিওতে সেই স্বরে প্রার্থনা ছড়িয়ে পড়ছে-

'ইয়া দেবী সর্বভূতেষু শান্তি রূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তস‍্যৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নম নমহ।'

বাড়ির ছেলেরা মফঃস্বল থেকে ভোরের ট্রেন ধরছে কলকাতায় যাবে। গঙ্গায় স্মান, তর্পনাদি সেরে গঙ্গাজল নিয়ে ঘরে ফেরা। আর যাদের গ্ৰাম বা তার আসেপাশে মা গঙ্গা বয়ে চলেছেন তারা সেখানেই সেদিন ভোরে উপস্থিত হন। 

তারপর তো শুধুই খুশি। তা সে একটা জামা হোক বা অনেক। আকাশটা কেমন হালকা নীল, মায়াময় নরম। যেন মায়ের আদর। আসেপাশের মাঠেঘাটে কাশফুলের দোলা। এমন প্রকৃতি দেখে মন খারাপ হওয়ার উপায়ই নেই। আসলে জগতের মঙ্গলকারিনী মা আসছেন যে। তাই তো এত খুশি। শৈশব থেকে আজও এইভাবেই শুরু হয় আমাদের দেবীপক্ষ। মহালয়ার দিন থেকে। তারপর সারা ভারত নবরাত্রি পালন করলেও বাঙালি তার ঘরের মেয়ের আগমনের দিন গোনা শুরু করে। বাড়ির দেওয়ালে সিঁদুর আর চালগুঁড়ো দিয়ে গিরি ছোপ, এয়োস্ত্রীদের নতুন শাঁখা পলা কেনা, বাড়ির পুজো হলে পাঁচ দিনের পাঁচটা ছাপা শাড়ি আবশ্যিক তালিকায় ঢুকে পড়ত। মধ‍্যরাত্রির পরেই লোকের বাগান থেকে ফুল চুরি করে জমা করা হত পুজোর জন‍্য। এসবই আমাদের কাছে রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চার ছিল। 

আমার নিজেদের বাড়ির পুজোয়ও এমনটাই দেখে এসেছি চিরকাল। বাড়ির পুজোর সাথে তাল দিয়ে চলত ঠাকুর দেখা। নতুন জুতোয় ফোস্কা পড়া পায়ের যন্ত্রনা ভুলে হেঁটে হেঁটে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঠাকুর দেখার মজাই ছিল আলাদা। তারপর যদি রিক্সা পাওয়া যেত তখন বাড়ির বয়স্কদের সাথে ছোটদের চাপিয়ে দেওয়া হত বাড়ি ফেরার জন্য। বিশাল পরিবারের বয়স্ক থেকে কুচো কাঁচা সকলেই তখন একসাথে দল বেঁধে বেরত মায়ের দর্শনের জন্য। তাই রিক্সায় স্থান সঙ্কুলান হওয়া মুশকিল। তখন আর কি কোলে, তার কোলে এমনকি রিক্সার পা দানিতেও ঠেসাঠেসি করে ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে বাড়ি ফেরা। 

এই যন্ত্র সভ‍্যতার সময়ে দাঁড়িয়ে এসব কথা আরও বেশি করে মনে আলোড়ন তোলে। এখনকার প্রজন্ম রিক্সার পা দানিতে বসার কথা ভাবতেই পারবে না। অথচ তখন কিন্তু এতে কোন মালিন‍্য ছিল না। সময়ের স্রোতে পরিবর্তন এসেছে সমাজে, অর্থনৈতিক জীবনে। রিক্সার বদলে বড় গাড়ি করে দলবেঁধে ঠাকুর দেখতে যায় অধিকাংশ মানুষ। পুজোর খাওয়া দাওয়া থেকে সাজপোশাক সবেতেই বদল এসেছে। 

বদলায়নি শুধু বাঙালির মন, বাঙালির সংস্কৃতি। তাই আজও মহালয়ার ভোর হয় রেডিও অথবা ইউটিউবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী শুনে। আজও পাশ্চাত্য পোশাক পরা কিশোরী, তরুণীরা দুর্গাপুজোর কদিন সেজে ওঠে শাড়ি গয়নায়। মেয়ের মধ্যে এভাবেই মায়ের রূপ ফুটে ওঠে। আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়ায় আকুল প্রার্থনা--

'শরণাগত দীনার্ত পরিত্রাণ পরায়নে,

সর্বসার্তি হরে দেবী নারায়নী নমস্তুতে'

সকলকে শারদ শুভেচ্ছা।

(www.theoffnews.com - durga puja)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours