তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

দুর্গা পূজা কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল–তা নিয়ে নানা মতভেদ আছে। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের, তারা পুজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের গঠন, দায়িত্ববোধ ও উর্বরতা শক্তির সমন্বয়ের কথা বিবেচনা করে অনার্য সমাজে গড়ে উঠে মাতৃপ্রধান দেবী সংস্কৃতির ধারনা। ভারতে অবশ্য মাতৃরূপে দেবী সংস্কৃতির ধারনা অতি প্রাচীন। ইতিহাস থেকে প্রমান পাওয়া যায়, প্রায় ২২,০০০ বছর পূর্বে ভারতে প্যালিওলিথিক জন গোষ্ঠি থেকেই দেবী পূজা প্রচলিত শুরু হয়েছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতা তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরও গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃত হয়। মাতৃপ্রধান পরিবারের মা-ই প্রধান শক্তি, তার নেতৃত্বে সংসার পরিচালিত হয়, তার নেতৃত্বে শত্রু নাশ হয়, আর তাই মাকে সামনে রেখে দেবী বিশ্বাসে গড়ে উঠে, গড়ে ওঠে শাক্ত সম্প্রদায় মত। এই মত অনুসারে দেবী হলেন শক্তির রূপ, তিনি পরমব্রহ্ম। শাক্ত মতে, কালী বিশ্ব সৃষ্টির আদি কারণ। অনান্য দেব দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তাঁর বিভিন্ন রূপে প্রকাশ মাত্র। মহাভারত অনুসারে, দুর্গা বিবেচিত হন কালী শক্তির আরেক রূপে। নানা অমিল ও বৈচিত্র থাকা সত্বেও কিভাবে কালী দুর্গার রূপের সাথে মিশে এক হয়ে গেল সে রহস্য আজও অজানা। কেউ কেউ ধারনা করেন, সিন্ধু সভ্যতায় (হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতা) দেবীমাতার, ত্রিমস্তক দেবতা, পশুপতি শিবের পূজার প্রচলন ছিল। দুর্গা শিবের অর্ধাঙ্গিনী, সে হিসাবে অথবা দেবী মাতা হিসাবে পূজা হতে পারে।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, দুর্গা পূজার প্রথম প্রবর্তক কৃষ্ণ, দ্বিতীয় বার দুর্গা পূজা করেন স্বয়ং ব্রহ্মা আর তৃতীয়বার দুর্গা পূজার আয়োজন করেন মহাদেব। আবার দেবী ভাগবত পুরান অনুসারে জানতে পারি, ব্রহ্মার মানস পুত্র মনু ক্ষীরোধ সাগরের তীরে দুর্গার আরাধনা করে বর লাভে সফল হন। মূল বাল্মীকির রামায়ণে, দুর্গা পূজার কোন অস্থিত্ব নেই। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়নে দুর্গাপূজার অস্থিত্ব আছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এটি মূল রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ নয়। মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কবি কৃত্তিবাস ওঝা সংস্কৃত রামায়ণ বাংলা করার সময় মূল রামায়ণের বাইরের তৎলালীন সমাজে প্রচলিত বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানা অনুষঙ্গ, অনেক মিথ, গল্প বাংলা রামায়ণে ইচ্ছাকৃতভাবে (নাকি গৌড়েশ্বর বা অন্য কারও অনুরোধে?) ঢুকিয়ে বাংলা রামায়ণ আরও অধিক সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেন। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, তিনি সংস্কৃত রামায়ণ উপাখ্যানের এমনভাবে বঙ্গীকরণ বা বাঙালীকরন করেন, যা পড়লে মনে হবে, রামায়নের ঘটনা তাঁর সমাজের আদি কাহিনী।

তাঁর এই অনুবাদকৃত রামায়ণ পরিচিত পায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামে, যা বাংলাভাষী হিন্দু সমাজে বেশ জনপ্রিয়তা পায়, সেখানে তিনি কালিকা পুরাণের ঘটনা অনুসরণে ব্রহ্মার পরামর্শে রামের দুর্গা পূজা করার কথা উল্লেখ করেছেন। শক্তিশালী রাবনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিজয় নিশ্চিত করতে শরৎকালে শ্রী রাম চন্দ্র দেবীদহ সাগর থেকে ১০১ টি নীল পদ্ম সংগ্রহ করে প্রাক্ প্রস্তুতি হিসাবে দুর্গা পূজা করে দুর্গার কৃপা লাভ করেন বলে কৃত্তিবাস ওঝা বর্ণনা করেছেন। তবে দুর্গা পূজার সব চাইতে বিশদ বর্ননা পাওয়া যায় মার্কণ্ডেয় পুরানে। যেখানে মহির্ষী জৈমিনি ও মহির্ষী মার্কণ্ডেয়র কথোপকথনের ভিত্তিতে পুরাণটি রচিত হয়। এই পুরাণের মধ্যে তেরটি অধ্যায় দেবীমহাত্ম্যম নামে পরিচিত। বাংলায় শ্রীশ্রী চন্ডি নামে সাতশত শ্লোক বিশিষ্ট দেবী মহাত্ম্যম পাঠ আছে, যা দুর্গা পূজার প্রধান ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পূজার আসরে স্থায়ী হয়ে গেছে ।

সনাতন ধর্মের আর্য ঋষিরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতীক হিসাবে দেবী দুর্গার আশীর্বাদ লাভের জন্য আরাধনা করতেন। মার্কণ্ডেয় পুরান মতে, চেদী রাজবংশের রাজা সুরাথ খ্রীষ্টের জন্মের ৩০০ বছর আগে কলিঙ্গে (বর্তমানে ওড়িষ্যা) দশেরা নামে দুর্গা পুজা প্রচলন করেছিল। অধুনা নেপাল রাষ্ট্রেও দশেরা বা দাশিন নামেই পুজা হয়। যদিও প্রাচীন উড়িষ্যার সাথে নেপালের পূজার যোগসূত্র আছে কিনা সে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। পুরাণ মতে, দুর্গা পূজার ইতিহাস আছে কিন্ত ভক্তদের কাছে সেই ইতিহাস প্রামানিক নয়, বিশ্বাসের।

পরিব্রাজক, বৌদ্ধ পন্ডিত হিউয়েন সাংকে নিয়ে দুর্গা পূজার একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। চীনা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাখায় বিভ্রান্ত হয়ে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের মূল পান্ডুলিপি সংগ্রহে ৬৩০ খ্রীস্টাব্দে ভারত সফরে আসেন। ভারত বর্ষের নানা বিহারে বিদ্যা অর্জন করেন। ৬৩৫-৬৪৩ পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর তিনি হর্ষবর্ধনের রাজ সভায় ছিলেন। তবে তাঁর কাহিনী দূর্গা, কালী, কালীর আরেক রূপ চন্ডী নাকি বন দেবীকে নিয়ে, তা নিয়ে ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে তিনি তাঁর রচনায় উল্লেখ করেছেন, হর্ষবর্ধনের সময়ে দস্যু তস্করের উপদ্রব খুব বেশি ছিল এবং তিনি নিজেও একাধিক বার দস্যুদের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন। তাঁর প্রবাস জীবনের কোনও এক সময়ে গঙ্গাপথে (প্রাচীন গঙ্গারিডি) এই পরিব্রাজক কোনও বৌদ্ধ বিহারে যাচ্ছিলেন, পথে দস্যুর কবলে পড়লেন। দস্যুরা তাঁকে বন্দি করে দেবী দুর্গার সামনে বলি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। কেউ মনে করেন, বন দেবী, কেউ মনে করেন কালী, কারণ প্রাচীনকালে নরমুন্ড ভোগ দেবার বিষয়টি বনদেবী বা কালী দেবীর জন্য প্রযোজ্য ছিল, যা এখন পাঁঠা দিয়ে পূরণ করা হয়। দুর্গা মা’কে খুশী করার জন্য নরমুণ্ড ভোগ দেবার বিষয়টি ইতিহাস থেকে জানা যায় না। তবে ইতিহাস বলে কলকাতার চিতু ডাকাত তাঁর আরাধ্য দুর্গা চিত্তেশ্বরীকে নরমুণ্ড উপহার দিতেন। যাই হোক, যখন বলির পূর্ব প্রস্তুতি প্রায় শেষ, এমন সময় প্রচন্ড বেগে ঝড় ছুটে এল। সব আয়োজন ঝড়ের কবলে লন্ডবন্ড হয়ে গেল। ডাকাতরা প্রাণ বাঁচাতে পালাতে লাগল। সেই সুযোগে হিউয়েন সাংও পালিয়ে যান। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Mahalaya Durgapuja)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours