তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়িতে নবকৃষ্ণ দেব দুর্গা পূজা শুরু করেন। তাঁর নির্দেশিত পথেই দুর্গা পূজা পরবর্তীকালে কলকাতার ধনিক বাবু সম্প্রদায়ের মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে। শাস্ত্রাচার এই সব পূজায় গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যে পূজায় যত বেশি সংখ্যক আমন্ত্রিত ইংরেজ অতিথি উপস্থিত হতেন, সেই পূজার মর্যাদা ততই বাড়ত। দেবী প্রতিমার সম্মুখেই মুসলমান বাইজি নাচের আসর বসত। ইংরেজরা এসে নাচগান করতেন, তাঁদের জন্য উইলসন হোটেল থেকে গরু ও শূকরের মাংস আনানো হত এবং মদ্যপানের আসরও বসত। রানি রাসমণি এই প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে শুদ্ধাচারে তাঁর জানবাজারের বাড়িতে দুর্গা পূজা শুরু করেন। তিনি ইংরেজ অতিথিদের চিত্তবিনোদনের বদলে তাঁর দেশীয় প্রজাদের বিনোদনের জন্য পূজা উপলক্ষে যাত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। ১৮৬১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর রানির জামাতাগণ নিজ নিজ বাসভবনে রানির প্রদর্শিত পথেই দুর্গা পূজার আয়োজন করতে থাকেন। কলকাতায় আরও অনেক বাড়িতে এই ভাবে দুর্গা পূজা শুরু হয়।
আধুনিক দুর্গা পূজার প্রাথমিক ধাপ ১৮ম শতকে নানা বাদ্যযন্ত্র প্রয়োগে ব্যক্তিগত, বিশেষ করে জমিদার, বড় ব্যবসাযী, রাজদরবারের রাজ কর্মচারী পর্যায়ে প্রচলন ছিল। বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কলারোয়ার খ্রীস্টীয় ১৮ শতকের মঠবাড়িয়ার নবরত্ন মন্দিরে (১৭৬৭?) দুর্গা পূজা হত বলে লোকমুখে শোনা যায়। পাটনাতে ১৮০৯ সালের দুর্গা পূজার ওয়াটার কালার ছবির ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে। উড়িষ্যার রামেশ্বরপুরে একই স্থানে ৪০০ শত বছর ধরে সম্রাট আকবরের আমল থেকে দুর্গা পূজা হয়ে আসছে। জমিদার বাড়ি থেকেই এই পূজার প্রচলন হয়েছিল।
বর্তমানে দুর্গা পূজা দুইভাবে হয়ে থাকে, ব্যক্তিভাবে, পারিবারিক স্তরে ও সমষ্ঠিগতভাবে, পাড়া স্তরে। ব্যক্তিগত পূজাগুলি নিয়মনিষ্ঠা ও শাস্ত্রীয় বিধান পালনে বেশি আগ্রহী হয়; এগুলির আয়োজন মূলত বিত্তশালী বাঙালি পরিবারগুলিতেই হয়ে থাকে। অন্যদিকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাসিন্দারা একত্রিত হয়ে যৌথ উদ্যোগেও দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন। এগুলি বারোয়ারি বা সর্বজনীন পূজা নামে পরিচিত।
পুরোনো অনেক বাঙালী বাবু দুর্গাকে মনে করতেন মেয়ে আর শিবকে মনে করতেন জামাই। দশমীর দিন তাঁরা দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে মেয়ে দুর্গাকে জামাই শিবের কাছে পাঠিয়ে দিতেন বলে কল্পনা করতেন। জামাইয়ের কাছে তাই আগাম খবর তারা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করতেন বিজয়ার দিন নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে। ভারতের কলকাতার শোভাবাজারের নবকৃষ্ণের বাড়িতে আর চোরাবাগানের মল্লিকবাড়িতে এই প্রথা এখনও চালু আছে। হাওড়া জেলার ডাঁসাই গ্রামের কাঙালীচরণ শিকারি এই দুটি বাড়িতে নীলকণ্ঠ পাখি জোগান দিতেন বলে জানা যায়। বাবুদের সংস্কার অনুসারে নীলকণ্ঠ পাখি হচ্ছে পবিত্র বার্তাবাহক।
সেকালের কলকাতার একজন উল্লেখযোগ্য পুরুষ হচ্ছেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি মুর্তি পূজার বিরোধী ছিলেন বলে দুর্গা ঠাকুর দেখতে যেতেন না। একবার তার বন্ধু প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর তাকে দুর্গা ঠাকুর দেখার নেমন্তন্ন করেছিলেন, কিন্তু রামমোহন তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বিদ্যাসাগর দুর্গা পূজার ব্যাপারে কৌতূহলী ছিলেন না। পূজার সময় তিনি দরিদ্র গ্রামবাসীদের কাছে চলে যেতেন।
সমষ্ঠিগতভাবে, বারো ইয়ার বা বারোয়ারী পূজা ১৭৯০ সালের পশ্চিম বঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তি পাড়াতে বারো জন বন্ধু মিলে টাকা পয়সা (চাঁদা) তুলে প্রথম সার্বজনীনভাবে বড় আয়োজনে দুর্গা উৎসব পালন করেন, যা ‘বারোইয়ার’ বা ‘বারো বন্ধুর’ পূজা নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়। কাশিম বাজারের রাজা হরিনাথ ১৮৩২ সালে বারোইয়ারের এই পূজা কলকাতায় পরিচিত করান। পরে তাদের দেখাদেখি আস্তে আস্তে তা উচ্চ বর্ণের হিন্দু বাঙালী জমিদারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সম্ভবত সেই থেকে বারোয়ারী পূজা শুরু।
স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন অদ্বৈতবাদী। শাস্ত্রসম্মত দুর্গা পূজার বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ১৯০১ সালে বেলুড়মঠে দুর্গা পূজার ব্যবস্থা করেছিলেন। অনেকের ধারণা, এটা ছিল শাস্ত্রশাসন আর লোকাচারের সঙ্গে তার আপস। তবে একথাও ঠিক, তার অদ্বৈতবাদের উপলব্ধি শেষ পর্যন্ত উত্তোরিত হয়েছিল মানবিকতাবাদে। সর্বোচ্চ মনুষ্যত্বকেই তিনি মনে করতেন ঈশ্বর। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্ ব্রহ্ম’ মন্ত্রে বিশ্বাসী। পরে সেই বিশ্বাস কেন্দ্রীভূত হয়েছিল দরিদ্র-শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে। তবুও তিনি দুর্গা পূজার বিরোধিতা করেননি। আবার দুর্গা পূজার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়েও পড়েননি।
১৯১০ সালে সনাতন ধর্ম উৎসাহিনী সভা ভবানীপুরে বলরাম বসু ঘাট লেনে এবং একই জেলায় অন্যান্যরা রামধন মিত্র লেন, সিকদার বাগানে একই বছরে ঘটা করে প্রথম বারোয়ারী পুজার আয়োজন করে।
বারোয়ারি দুর্গা পূজা মুষ্টিমেয় কয়েকজনের চাঁদার টাকায় অনুষ্ঠিত হত। কিন্তু সার্বজনীন দুর্গা পূজা হয়ে থাকে জনসাধারণের চাঁদার টাকায়। চাঁদা তোলার সময় উদ্যোক্তারা ধনী, দরিদ্র সবারই দ্বারস্থ হয়। অনেক সময় বাড়াবাড়িও করত। সার্বজনীন দুর্গা পূজার পত্তন হয় কলকাতায়, ১৯২৬ সালে। সিমলা আর বাগবাজার—দু জায়গায় সে বছর সার্বজনীন দুর্গা পূজা হয়। সিমলা ব্যায়াম সমিতির অতীন্দ্রনাথ বোস ছিলেন প্রথমটির উদ্যোক্তা। সিমলার প্রতিমাটি তৈরি করেছিলেন কুমোরটুলির বিখ্যাত মৃৎশিল্পী নিমাই পাল। প্রথম বছরে মুর্তিটি ছিল একচালা বিশিষ্ট।
১৯২৬ সালে অতীন্দ্রনাথ বোস জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে পূজা উৎসবে অংশ গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে দুর্গা পূজা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বৃটিশ শাসিত বাংলায় এই পূজা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দেবী দুর্গা স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে জাগ্রত হন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই পূজা ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারী বা কমিউনিটি পূজা হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর স্বাধীনতার পর এই পূজা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান উৎসবের মর্যাদা পায়।
বাগবাজারে দুর্গা পূজা সার্বজনীন নামে অভিহিত হয় ১৯২৬ সালে। এই পূজা আগে ছিল বারোয়ারি। সূচনা ১৯১৮ (বা ১৯১৯) সালে। স্থানীয় কিছু যুবক এক ধনীলোকের বাড়িতে দুর্গা ঠাকুর দেখতে গিয়ে অপমানিত হন। পরের বছর তাঁরা বারোয়ারি পূজা চালু করেন। সবার জন্য তারা উন্মুক্ত করে দেন পূজা মণ্ডপের দ্বার। এই পূজার উদ্যোক্তা ছিলেন — রামকালী মুখার্জি, দীনেন চ্যাটার্জি, নীলমণি ঘোষ, বটুকবিহারী চ্যাটার্জি প্রমুখ। সঠিক অর্থে এই পূজাই ছিল কলকাতা তথা তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রথম সার্বজনীন দুর্গা পূজা।
প্রথম সার্বজনীন পূজায় বাধা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন অনেক রক্ষণশীল পণ্ডিত। শেষ পর্যন্ত তারা সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন পণ্ডিত দীননাথ ভট্টাচার্যের হস্তক্ষেপে। এখন সার্বজনীন দুর্গা পূজার ছড়াছড়ি। এই পূজারই রমরমা। বাড়ির পূজা আজ স্তিমিত।
১৯৩৮ সাল থেকে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক আর গণেশ প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা চালের ব্যবস্থা হয়। শুরু হয় কুমোরটুলি সার্বজনীনের দুর্গা পূজা থেকে। শুরু করেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৩৮ সালে কুমোরটুলি সার্বজনীনের নতুন সভাপতি হলেন সুভাষচন্দ্র বসু৷ কিন্তু পঞ্চমীর দিনই ঘটে গেল মহাবিপত্তি৷ মন্ডপে চলে এসেছে একচালার ঠাকুর (সেইসময় একচালার প্রতিমাই পুজো হত)৷ হঠাৎ বিকেলে মন্ডপে আগুন লেগে যায়৷ মন্ডপ, প্রতিমা, সব পুড়ে ছাই৷ অথচ পরের দিনই বোধন৷ নেতাজি ছুটে গেলেন শিল্পী গোপেশ্বর পালের কাছে৷ বললেন, যেভাবেই হোক এক রাতের মধ্যে ঠাকুর তৈরি করে দিতেই হবে৷ সেকথা শুনে তো শিল্পী অবাক৷ তা কি করে সম্ভব? মুহূর্তের মধ্যে নেতাজি সিদ্ধান্ত নিলেন আলাদা আলাদা করে প্রতিমা গড়া হবে৷ জি পাল দুর্গা প্রতিমা গড়লেন৷ আর অন্যান্য শিল্পীরা গড়লেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ৷ একচালা ভেঙে তৈরি হল পাঁচ চালার ঠাকুর৷ এক রাতের মধ্যেই সব তৈরি৷ ষষ্ঠীর দিন মন্ডপে এল প্রথম পাঁচ চালার ঠাকুর৷ যা সম্ভব হয়েছিল নেতাজির জন্যই৷ পুজো কমিটির বহু পুরোনো সদস্যরা সাম্প্রতিক অতীতে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, সেবার একেই তো পাঁচ চালা আর তার উপর দেবীর জমকালো সাজসজ্জা দেখে পুরোহিত সমাজ বেঁকে বসেছিল৷ তারপর শিল্পীর সঙ্গে বহু আলোচনার পর মেলে পুজোর পুরোহিত৷ তবে এটাই শেষ প্রথা ভাঙা ছিল না৷ পরের বছর নেতাজি পুজো কমিটির সভাপতি থাকাকালীন কুমোরটুলি সার্বজনীনের দেবী দুর্গার গায়ে উঠেছিল সত্যিকারের বাঘের ছাল৷ যদিও এখনকার দিনে হলে নিশ্চিতভাবে ‘পেটা’-র প্রতিবাদের মুখে পড়তে হত পুজো কমিটিকে৷ (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews.com - Mahalaya Durgapuja)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours