কাজী নূর, কবি, সাহিত্যিক ও ফিচার রাইটার, বাংলাদেশ:

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া সরু লম্বাটে আকৃতির ছাতিম গাছকে অঞ্চল ভেদে ছাইতান, ছয়তাইন্যা, ছাতিয়ান, ছাইত্তান, ছাইত্তান্না বা ছাতিম নামে ডাকা হয়। একটা সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কমবেশী ছাতিম গাছের দেখা মিলতো। নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে ছাতিম গাছ এখন বিলুপ্ত প্রায়। দুর্লভ ছাতিম গাছের রয়েছে নানা ঔষধি গুণ। এ গাছের ছাল এবং আঠা জ্বর, হাঁপানি, কুষ্ঠ, চর্ম ও আমাশয় রোগ নিরাময়ে অত্যন্ত কার্যকরী। ছাতিম গাছের ছালের নির্যাস উচ্চ রক্তচাপ এবং ক্যান্সারের ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ছাতিম ফুলের গুড়ো ও পিপুলের গুড়ো দইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে হাঁপানি ও শ্বাসকষ্ট দূর হয়। ছাতিমের ছাল সেদ্ধ করা পানি মুখের অরুচি ও জ্বর দূর করে। ছাল সেদ্ধ করা পানি কুসুম গরম দুধে মিশিয়ে খেলে মুত্ররোগ দূর হয়। ছাতিম থেকে হারবাল, হোমিওপ্যাথি ঔষধ তৈরী করা হয় যা আমাশয়, উদরাময় এবং রক্তশূন্যতা রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। ছাতিমের ছাল ভালো করে সেদ্ধ করে পানি ও দুধ একসাথে মিশিয়ে খেলে মায়েদের বুকের দুধ বাড়ে।

চিরসবুজ ছাতিম গাছের কাণ্ডগুলো ছাতার মতো বেষ্টিত হয়ে থাকে এজন্য এ গাছটির নাম ছাতিম হয়ে থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। একসঙ্গে সাতটি দৃষ্টিনন্দন পাতা যুক্ত থাকায় ছাতিমকে সংস্কৃত ভাষায় 'সপ্তপর্ণ' বা ‘সপ্তপর্ণী’ উদ্ভিদ বলে। ছাতিম ফুল ফোটে হেমন্তের শুরুতে এবং তা থাকে শীতের মধ্যভাগ পর্যন্ত। এমন সময়ে ফোটার কারনে ছাতিম ফুলকে অনেকে 'হেমন্তের উপহার' বলে থাকেন। এ মৌসুমে গোটা গাছে সাদা এবং বড় বড় গুচ্ছ ফুলে ছেয়ে যায়। হেমন্তের সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি ছাতিম ফুল তীব্র মিষ্টি গন্ধ ছড়ায়। ছাতিম ফুলের মাদকতাময় মিষ্টি সুবাসে মোহাবিষ্ট হয়নি এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। শীতের শেষে ছাতিম গাছে লম্বাটে আকৃতির ফল বা বীজ ধরে। 

বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন এবং ভিয়েতনাম ছাতিম গাছের আদি নিবাস। ছাতিম গাছের ছালের ভেতর অংশ সাদা এবং উপরটা ধূসর খসখসে। এ গাছের অভ্যন্তরে দুধের মতো সাদা এবং অত্যন্ত তেতো কষ বা আঠা থাকে। ছাতিম কাঠ নরম এবং সাদা রঙের। এর কাঠ থেকে জ্বালানী, চায়ের পেটি, হালকা মানের আসবাব, দেশলাইয়ের কাঠি, চামচ, ব্লাকবোর্ড, পেন্সিল এবং কফিন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ছাতিম গাছকে ইংরেজিতে ডেভিল’স ট্রি (Devil’s tree) বলা হয়। যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ভূতের গাছ।

ছাতিম ফুল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ফুলগুলোর মধ্যে একটি। হয়তো এজন্যই রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, 'ঊষার ছোঁওয়া জাগায় ওরে/ছাতিমশাখে পাতার কোলে'। শান্তি নিকেতনে সমাবর্তনের সময় কবিগুরু প্রথমে উপহার দিতেন ছাতিম পাতা। বাংলাদেশের প্রয়াত বিজ্ঞান লেখক, বৃক্ষাচার্য, অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা তার 'শ্যামলী নিসর্গ' নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ছাতিমই বোধহয় একমাত্র বৃক্ষ যে হেমন্তের অঙ্গনে দাঁড়িয়ে প্রস্ফুটন আর সুগন্ধের পল্গাবনে এই দুরন্ত শীতকে অভ্যর্থনা জানায়।

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং। ছাতিম গাছের ছবিটি চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত যশোর প্রাঙ্গণ থেকে তোলা।)

(www.theoffnews.com - Bangladesh Devil's tree)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

2 comments so far,Add yours

  1. লেখক তার সুনিপুণ হাতে ছাতিম গাছের চমৎকার বর্ণনা করেছেন। চাই প্রকৃতির অপরুপ লীলাভূমিকে সে আপনার করে আরও প্রকাশ করুক। শুভকামনা সবসময়।

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ প্রতিবেদন

    ReplyDelete