সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

বাড়ির গা লাগোয়া দুর্গা মন্ডপ। সেখানেই অষ্টমীর সন্ধ্যায় একটা চেয়ারে চুপটি করে এসে বসলাম। একদম একাকী। পরণে নিত্য ব্যবহার্য বারমুডা প্যান্ট আর ফুলহাতা শার্ট। আসলে মন আর শরীর সায় দিচ্ছিল না কিছুতেই। পুজোতে, পুজোর জন্য কেনা পোশাক গায়ে লাগাতে ইচ্ছেই করছে না আর। মেয়েটা এবারও পুজোয় ঘরে এলো না। এনজিওর স্পেশাল চাইল্ডদের নিয়ে কলকাতায় পুজো দেখবে বলে। আবার ষষ্ঠী থেকে আমার শরীরেও ঠিক যুৎ পাচ্ছি না।

শরীরের ও মনের এই উদাসী পানসে হাওয়ার দাপটে, মিষ্টি স্ত্রীর সঙ্গে পুজো কাটানোর বজরাতে তাই লেগেছে টলমলে অছন্দ। চতুর্থীর সারারাত যৌথভাবে দেবী দর্শন না হয় হতেই পারে। গাড়ি করে। তবু স্বীকার করি, বাকি গোটা পুজোর প্রত্যাশার দুধে যে চোনা পড়ে গেল তাঁর। তাই গিন্নি মহাদয়া কিঞ্চিৎ অভিমানী আমার উপর, তা আমি বিলক্ষণ অনুভব করি ও করছিও। আসলে মন্ডপের চেয়ারে বসে বসে এসব যখন আকাশ কুসুম ভাবছি তখন হঠাৎ দেখি আমার অদূরে হোম মিনিস্টার। মন্ডপের অপর প্রান্তে উনি বসে আছেন জনা কয়েক প্রতিবেশিনীর বৃত্তাকারে। পরনের নীল শাড়িতে তাঁকে কিন্তু বেশ সুন্দরী লাগছিল। যাই বলুন না কেন। একবার ভাবলাম বলি, সুন্দরী গো মান করো না। পরক্ষণেই আমি হয়ে উঠলাম লাল পর্দায় শিং গোঁতানো মেক্সিকান বুল। মনে মনে ভাবলাম, হাম কিসিসে কম নেহি। তাই নীলাম্বরী সুন্দরী বন্দনা আপাতত স্থগিত হয়ে যায় তখনই।

কখন যে অষ্টমীর কচি সন্ধ্যার লগ্ন পেড়িয়ে শুরু শুরু রাতের সন্ধিপুজো সুচনা হয়ে গেল তা বুঝলামই না। বুঝলাম তখনই। যখন ঢাকের ঢ্যাং কুরকুর ঢ্যাং কুরকুর উচ্চ বোলে কাঁসর ঘন্টার টঙ টঙ চেনা তাল কি শারদীয় রীতিতেই না মিশে মিশে যাচ্ছে আকাশে বাতাসে।

আরে? আরে? একি দেখছি! মন্ডপে উপস্থিত একাংশ মহিলাদের মুখে তো মেকআপ জাঙ্ক ভরপুর। অনেকের চুলে বাহারি কাট্ কিন্তু অনায়াসে পুজোর আবহকেই মনমাতাল করে তুলেছিল। ইয়ং মুখ জানা গাইদের ক্রাক জিনস সঙ্গে হ্যান্ডি হেয়ার ছাঁট তো বাড়তি জমজমাট বোনাস। ফাটাফাটি পুজো অ্যাম্বিয়ান্স যাকে বলে। রাত একটু বাড়তেই স্বল্প অসুস্থতার কারণে আমার হালকা ঠান্ডাও লাগছে মাঝে মাঝে। কিন্তু গুরু, একটা দৃশ্য আমার যতসব বর্ণিত বর্ণনাকে ক্ষণিকেই ম্লান করে দিল। এতো অবাক করা বৈপরীত্য। একজন ঢাকিভাই এক জীর্ণ সাদা পাঞ্জাবি পরে আছে। টানা ঘন্টা খানেক ধরে সে বাজিয়ে চলেছে ঢাক। তালে বোলে তাঁর দুটি পা চেনা চেনা তরঙ্গে নেচে উঠছে। বারবার। আর পরণে পাঞ্জাবিটা পিঠের দিকে ঘামে এক্কেবারে জবজব করছে। এই ঘাম আসলে সবার উৎসবের আমেজে একক বেঁচে থাকার তাঁর নিজস্ব শ্রম প্রতীক। আসলে এটাই যে কঠিন বিপরীত দুনিয়া। আসলে এটাও যে সার্বজনীন। কি শারদে কি অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। হ্যাঁ এটাই তো সত্য। বহুল প্রতিষ্ঠিত অধ্যায়ে। 

খানিক পড়েই সন্ধিপুজো শেষ। ঢাকের কাঠিতেও যেন বিরতির ক্লান্তি। ঢাকিভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'এমন যে ঘেমে প্রাণপাত করে ঢাক বাজালেন, সবাইতো আনন্দ পেল, আপনি কি পেলেন?' সহজ সরল উত্তর। 'সবাইকে আনন্দ দিয়ে আমিও তো পুজোর আনন্দ পেলাম।' ফের বললাম, 'বাড়ির বাচ্চাদের ও বৌকে নতুন কাপড় কিনে দিয়েছেন?' এবার সে মাথা নিচু করে লাজুক ভাবে বললো, 'কিনেই যদি দিতে পারতাম তবে বাড়ি ছেড়ে এখানে কেন আসবো বলুন। ঢাক বাজিয়ে কিছু টাকা পাবো। সেই দিয়েই বাড়ি ফিরে কেনাকাটা করবো।'

কি অদ্ভুত বাস্তব তাই না? মন্ডপে নতুন পোশাক পরিহিতদের ভিড় অনেকটাই দাম্ভিক ঘন। অধিকাংশই কিন্তু নানা বিষয়ে যথেষ্ঠ সমঝদারও। তারই মধ্যে একজন ঢাক বাজিয়ে চলেছে। বিচ্ছিন্ন তাগিদে। জীর্ণ শীর্ণ ভেজা পাঞ্জাবিতে। তাঁর ঢাকের তালে পুরোহিতের ঘন্টা দোলে। কতজনের মন নাচে। অঙ্গ নাচে। অথচ ঢাকিভাইয়ের পিঠে দরদর করে ঝড়ে পড়া ঘামের হিসেব কে রাখে? বড়জোর পুজো কমিটি প্রাপ্য দিয়ে দায়িত্ব পালন করবে। এটাই তো পেশাদারীত্বের দস্তুর। কিন্তু তাঁর ঘামের হিসেব দূর থেকে সবার অলক্ষ্যে কিন্তু ঠিক রেখে চলেছেন একজন। রাতটো গেলেক অষ্ঠমী চলি গেলেক গো। আইজকে নবমী ন। সেই একজন কে জানেন? তিনি মধুমালা। ঢাকিভাই সুভাষ বাদ্যকরের ঘরণী যে। বাঁকুড়ার বড়জোড়া ব্লকের শিলদা গ্রামের ছাপোষা গৃহবধূ মধুমালা এখন সত্যি মধুময় একরাশ হিসেবে বিভোর। একাদশীর দিন তাঁর মরোদ আইসব্যাক। সে ঘরে আলি পড়ে একটা ডাগর দ্যেইখে শাড়ি কিনতে হবেক ন। উফ্ কি যে খুশি হইনছিক কি বলি লো।

লেখাটা লিখছিলাম নবমীর বিকেলে। আচ্ছা লেখার বল্গা নেশায় দিবাস্বপ্ন দেখে ফেললাম নাতো। কে জানে? ভুল করলে মাফ করবেন বাবুরা, দিদিরা।

(www.theoffnews.com - durgapuja)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours