দেবিকা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও লেকচারার, চন্দননগর, হুগলি:

ভেবেছিলাম মানস ভ্রমণে কোনও বাধা-বিপত্তি, ঝুট ঝামেলা নেই। কিন্তু সদলবলে মানস ভ্রমণে বেরিয়ে দেখি, মনটাই বড় বিপত্তির কারণ। সে এত অবুঝ, থেকে থেকে বিস্তর ঝামেলায় ফেলে দেয়। কায়িক বা মানসিক যত কিছু কাজ আছে, তা সমাধা করা যায় 'স্থিতপ্রজ্ঞ' হলে।

মনে হয় বায়ুবশ কঠিন যেমন। 

এই মন বশে রাখা কঠিন তেমন।।

মনের বশবর্তী না হয়ে মনকে বশে রেখে চলো আজ ঘুরে আসি কালনার খ্যাত-অখ্যাত কতগুলি দর্শনীয় স্থান থেকে। এমন নয় যে, এগুলি স্থাপত্য ভাস্কর্যের দিক থেকে দর্শনীয়। কিন্তু ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে কোনও কোনও জায়গার। বিখ্যাত জায়গাগুলির প্রতীক্ষায় রয়েছে সবাই, তা জানি। কিন্তু সেসব জায়গা আগে যদি ঘুরে আসি এইসব স্থান যেমন অন্ধকারে আছে তেমনই থেকে যাবে।

১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে কালনা শহরের বিদ্যাবাগীশ পাড়ায় বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে জন্ম কালী সাধক কমলাকান্তের। ভট্টাচার্য ছিল তাঁদের প্রাপ্ত উপাধি। কমলাকান্তের বাবা মহেশ্বর ভট্টাচার্য ছিলেন নদীয়া রাজগুরু বংশের পূর্বপুরুষ পণ্ডিত রামচন্দ্রের শাখা বংশধর। তাঁর অকাল প্রয়াণ ঘটে পুত্রের শৈশবেই। পারিবারিক অস্বাচ্ছন্দ্যের কারণেই দুই পুত্রকে নিয়ে তাঁর মা মহামায়াদেবী চলে আসেন চান্না গ্রামে বাপের বাড়িতে। গ্রামটি বর্ধমান–আসানসোল বা বর্ধমান–বোলপুর রেল পথে খানা জংশনের কাছাকাছি এলাকায় অবস্থিত। পরে চান্নারই বিশালাক্ষী মন্দিরে কমলাকান্ত পূজারী নিযুক্ত হন এবং টোল স্থাপন করেন। বিশালাক্ষী মন্দিরেই একটি পঞ্চমুণ্ডির আসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং শ্যামাসাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন। বর্ধমান মহারাজা তেজচন্দ্র ও প্রতাপচন্দ্রের গুরুদেব ছিলেন তিনি। বর্ধমান রাজ পরিবারের সভাপণ্ডিতও ছিলেন। শাক্ত কবি হিসাবে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন।

কালনার জন্মভিটেটি দীর্ঘদিন অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকার পর স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগে সেটির সংস্কার সাধন সম্ভব হয়েছে। এখানে এক কালীমূর্তি রয়েছে, নিত্য পুজোর ব্যবস্থাও আছে। কালীপুজোর সময় জন্মভিটেতে নিষ্ঠার সঙ্গে কালীপুজোর আয়োজন করা হয়।

এবার যাই, কালনার কাঁসারি পাড়ায় আনন্দ আশ্রমে যেটা এক সন্ন্যাসিনীর দ্বারা স্থাপিত, পরিচালিত। শোনা যায় যে সন্ন্যাসিনীর মূর্তি রয়েছে সেখানে, সেই মূর্তি নেপালের রাজকুমারীর। তিনি সংসার জীবনে প্রবেশ করতেই চাননি আর সেজন্যই পিতার আলয় ছেড়ে বেরিয়ে, বিভিন্ন জায়গা পরিভ্রমণ করে কালনায় এসে তাঁর জীবন অতিবাহিত করেন। নেপালের অধিবাসী শৈব ধর্মাবলম্বী হওয়ায় সেই মঠে রয়েছেন জ্ঞানেশ্বর মহাদেব; তাঁর পুজাও হয় বছরভর। এই আশ্রমটি, বন্ধু, তোমাদের জন্য বিস্মৃতির অতল থেকে মানস চক্ষে ভেসে উঠল। কথা দিলাম, সে যদি ভালো থাকে আর যদি আমিও, প্রত্যক্ষ করাবো একদিন। সে আমার বড় প্রিয় জায়গা ছিল। কারণ? অনুমান করে নিও। 

আর এক মন্দির রয়েছে কালনা স্টেশন থেকে শহরের দিকে এগিয়ে এসে বারুইপাড়ার দিকে। যোগানন্দের ঝুপড়ি। সেখানে নাকি মাটির নীচে নরবলি হতো। বাবার সঙ্গে গিয়ে দেখেছি মাটির নীচে নয়, বরং একটু ওপরের দিকে এক কালীমূর্তি। গল্প শুনে ভয় ভয় করতো, তাই চারপাশে কখনও ভালো করে তাকাইনি। তবে বর্তমানে মন্দিরটি সংস্কার করা হয়েছে।

১৯৩০সালের ১৫ই আগষ্ট মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে হয়েছিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। এ আমরা সবাই জানি, যেটা জানি না, সেটা হলো এই কাজে যাঁরা সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন উপেন্দ্র নাথ পাল। পরবর্তীকালে তিনি হয়ে ওঠেন নিত্যগৌরবানন্দ অবধূত মহারাজ। অম্বিকা কালনায় গড়ে তোলেন জ্ঞানানন্দ মঠ। এই মঠ একসময় বিপ্লবীদের আখড়া ছিল। আসতেন মাস্টারদা, বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত সহ অন্যান্য বিপ্লবী। এসেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি এখানে রাত্রিবাস করেছিলেন বলেও জানা যায়। তাঁর ব্যবহৃত চেয়ার, খাট স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে আজও রক্ষিত আছে। বর্তমানে সেখানকার মহারাজ নিত্য প্রেমানন্দ অবধূত জানান, মঠ রক্ষণাবেক্ষণ কষ্টকর হয়ে উঠেছে, কারণ প্রতিশ্রুতি মিললেও সাহায্য মেলে না। তাই এখানে এলে মঠের অধীনে এত বড় জায়গাটির ইঁটের পাঁচিলের গায়ে দেখতে পাবো অবহেলার চিহ্ন। কালনা মহকুমা হাসপাতালের কাছে দু'পাশে সুপুরি গাছ দিয়ে এককালে সাজানো মঠটি বিপ্লবীদের কার্যালয় হিসেবে কেমন ছিল, কল্পনা করে নিতে হবে।

এবার যাবো অম্বিকা কালনার জাপটে ভবাপাগলার ভবানী মন্দিরে। আজকের ভ্রমণে অন্য মন্দিরগুলির তুলনায় পরিচিত এই মন্দির। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের আমতা গ্রামে ভবাপাগলার জন্ম কিন্তু সাধনস্থল হিসাবে কালনাকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। যোগেন্দ্র চৌধুরী এবং জয়া দেবীর তিন সন্তান—গিরীন্দ্র, ভবেন্দ্র এবং দেবেন্দ্রনাথ। ভবেন্দ্র  মোহন চৌধুরীই হলেন ভবা পাগলা। মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও মাত্র সপ্তম শ্রেণি অবধি পড়াশোনা করেন। অল্প বয়স থেকেই মা কালীর সাধনায় ব্রতী হন। কথা কতটা সরল করে বললে মনের কথাটা সবাই বুঝবে, তা খুব ভালো জানতেন কালী সাধক ভবাপাগলা। একাধারে শাক্ত কবি ও অন্য দিকে শিল্পী এবং মাতৃসাধক হিসাবে পরিচিত ছিলেন ভবাপাগলা। তাঁর রচিত শ্যামাসঙ্গীত আজও কালীভক্তদের মুখে মুখে ফেরে। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা কয়েক হাজার। বাল্য বয়সে তিনি প্রতিমা নিয়েই খেলা করতেন। ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে কিছু দিন কলকাতায় কাটানোর পরে চৈতন্যদেবের জন্মস্থান নবদ্বীপে যাওয়ার পথে কালনায় এসে তাঁর ভালো লেগে যায়। তৈরি করেন ভবানী মন্দির। এই মন্দিরে বসেই তিনি লিখেছেন প্রচুর গান ও কবিতা। তাঁর রচিত সেই সমস্ত গান জায়গা করে নেয় মানুষের মনে। তৈরি হয় তাঁর বহু গুণমুগ্ধ ভক্ত। শুধু ভিন রাজ্য নয়, ভিন দেশেও ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর ভক্ত। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভবাপাগলা তাঁর কবিতা ও গানের মাধ্যমে লোক শিক্ষার কাজও করে গিয়েছেন। বেশ কিছু বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন এই সাধক। আলপনা, বেহালা বাজানো, সেলাই, অঙ্কন, হারমোনিয়াম বাজানো--- সবেতেই পারদর্শী ছিলেন তিনি। তাঁর আঁকা ছবি সাজানো রয়েছে মন্দির জুড়ে। ভবাপাগলার ভক্তের তালিকায় রয়েছেন মহানায়ক উত্তম কুমার, মলিনা দেবী, গুরুদাস বন্দোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা। হৈমন্তী শুক্লার মতো অনেক নামী শিল্পী তাঁর রচিত সাধন সংগীত গেয়েছেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ বসু গুণমুগ্ধ ছিলেন ভবাপাগলার। বেশ কয়েকবার তিনি এসেছিলেন ভবার ভবানী মন্দিরে। তাঁর লেখা ‘মুক্তবেণীর উজানে’ ও ‘চলো মন রূপনগরে’--- এই দু’টি উপন্যাসে ভবাপাগলার চরিত্র চিত্রন করেছেন।

ভবানী মন্দিরে বছরভর পুজো হয়। ভবাপাগলার আরাধ্য কালী মূর্তিটি কষ্টি পাথরের। কালীপুজোর দিন বিশেষ পুজো হলেও মহাপুজো অনুষ্ঠিত হয় বৈশাখ মাসের শেষ শনিবারে। বহু লোক সমাগম হয় এই সময়। সম্ভবত বছর দুয়েক আগে এই অনুষ্ঠানের সময়েই উপচে ভরা ভক্তের ভিড়ে লঞ্চ ডুবির খবর পাওয়া গিয়েছিল। এখানে কালী পুজোর বৈশিষ্ট্য হলো ১০৮টি প্রদীপ জ্বালিয়ে সন্ধ্যাবেলা পুজো শুরু করা। ভবাপাগলা নিজে  পশুবলির ঘোরতর বিরোধী হওয়ায় রীতি মেনে কলা, শসা, আদা, আম ও কুমড়োর বলি হয়। নিত্য পুজোয় ভবাপাগলা দেবীকে খিচুড়ি, মিষ্টি, ফলের ভোগ দিতেন। রীতি মেনে আজও নিত্য পুজোয় তেমনই ভোগ নিবেদন করা হয় দেবীকে। জনশ্রুতি আছে, রোগাক্রান্ত কাউকে ভবা স্পর্শ করলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠতেন। বাস্তববাদী ভবা ভক্তদের বলতেন, জন্মিলে মরিতে হবে। নিজের জীবদ্দশাতেই মন্দিরের সামনে বানিয়ে রেখেছিলেন সমাধি। নির্দেশ দিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর যেন তাঁকে সেখানেই সমাধিস্থ করা হয়। শিশুদের খুব ভালোবাসতেন এই সাধক। শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য মন্দির জুড়ে গড়ে তুলেছিলেন পশুশালা যার অবশিষ্টাংশের কিছু আমরা দেখতে পেলেও আজ আর কিচ্ছুটি নেই।

আগামীদিন হয়তো আমাদের কাঙ্ক্ষিত মন্দির চত্বরে চলে আসব। আজকের  মতো বিদায়, বন্ধু! (ক্রমশঃ)

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(www.theoffnews.com - Ambika Kalna)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours