ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:
মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক ছাড়াও মঞ্চে বাংলা নাটক রয়েছে উল্লেখযোগ্য। ১৯৭২ সালে মঞ্চ সারথী আতাউর রহমানের প্রথম নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘রক্তকরবী’ ঢাকার মঞ্চে এনেছিল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। এ নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন মঞ্চসারথী আতাউর রহমান। নাটকটি এতই জনপ্রিয় হয়ে আছে যা আজও দর্শকের কাছে সমান ভাবে সমাদৃত। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক রচিত ‘নুরুলদীনের সারাজীবন’ নাটকটি সর্বপ্রথম ১৯৮২ সালে মঞ্চে আনে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। কৃষক বিদ্রোহের নেতা নুরুলদীনের জীবন চেতনা নিয়ে নির্মিত এ নাটকটি মানুষের মনে এখনও হীরক খচিত হয়ে আছে। ফরাসি নাট্যকার মলিয়ের লেখা থেকে রূপান্তরিত নাটক ‘বিচ্ছু’। এ নাটকটি নাট্যরূপ ও নির্দেশনা দিয়েছেন তারিক আনাম খান। ১৯৯১ সালে সর্ব প্রথম মঞ্চে আনে নাট্যকেন্দ্র। যা এখনও মানুষ পছন্দ করে। ফরাসি নাট্যকার মলিয়ের ‘দ্য মাইজার’ থেকে রূপান্তর করে তারিক আনাম খান নাম দেন ‘কঞ্জুস’। নাটকটির নির্দেশনা দেন লিয়াকত আলী লাকী। লোকনাট্য দলের এ নাটকটি গত ৩০ বছর ধরে মঞ্চস্থ হয়ে আসছে দর্শকদের ভালবাসায়। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের ‘যৈবতী কন্যার মন’ নাটকটি প্রথম মঞ্চে আনেন ঢাকা থিয়েটার। নির্দেশনায় ছিলেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। বিনোদিনী দাসীর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমার কথা’ ও ‘আমার অভিনয় জীবন’ এর আলোকে রচিত হয়েছে ‘বিনোদিনী’ নাটকটি। নাট্যরূপ দিয়েছেন সাইমন জাকারিয়া এবং নির্দেশনায় নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। এক অভিনয়ে দর্শক প্রিয় হয়ে ওঠেন শিমুল ইউসুফ। ১৯৭৭ সালে প্রথম নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় মঞ্চে আনেন ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’। বের্টল্ড ব্রেশটের মূল নাটকটির রূপান্তর ও নির্দেশনায় ছিলেন আসাদুজজামান নূর। বেহুলা লখিন্দর উপাখ্যান অবলম্বনে ‘বেহুলা ভাসান’ নাট্যরূপ দেন ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ। ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটকটি প্রথম মঞ্চায়ন হয়। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকটি বাংলানুবাদ করেন ড. ইস্রাফিল শাহিন। তাঁর নির্দেশনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা এটি নাটমন্ডলে মঞ্চায়িত করেন। আরন্যক নাট্যদলের উল্লেখযোগ্য নাটকের রচয়িতা ও নির্দেশক মামুনুর রশিদ। তিনি নির্দেশনা ও রচনা করেছেন ওরা কদম আলী, ওরা আছে বলেই, সংক্রান্তি উল্লেখযোগ্য।
বর্তমান সময়ে পূর্বের অনেক ঐতিহ্যবাহী নাট্যদল ভেঙ্গে গেছে। অনেকে কোন মতে টিকে আছে। এছাড়াও নতুন কিছু নাট্যদল তৈরি হয়েছে। তাদের মধ্যে ‘প্রাঙ্গনে মোর’ অন্যতম। এ দলের প্রধান কর্ণধার হিসেবে রয়েছেন নুনা আফরোজ। পুরানো আর নতুনের এক সংমিশ্রনে এ দলের প্রত্যেকটি নাটক দর্শকের হৃদয়ে দাগ কাটতে বাধ্য। এ পর্যন্ত প্রাঙ্গনেমোর নাট্যদলের অধিকাংশ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে নুনা আফরোজকে দেখা যায়। এছাড়াও তিনি দর্শকপ্রিয় নাটকের নির্দেশকও। স্বদেশী, লোকনায়ক, দ্রোহ প্রেম নারী, শ্যামাপ্রেম, শেষের কবিতা, ঈর্ষা, মাইকেল মধুসুধন, হাছন জানের রাজা ও কনডেমড সেল উল্লেখযোগ্য।
মান্নান হীরার রচনা ও নিদের্শনায় ‘উৎস নাট্যদল’র নাটক স্বর্নজননী বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রয়েছে ইবলিশ, বর্ণমালার মিছিল। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একক নাটক ‘লাল জমিন’ বেশ প্রসংশনীয় হয়েছে। নাটকটি রচনা করেছেন প্রয়াত মান্নান হীরা এবং নির্দেশনা দিয়েছেন সুদীপ চক্রবর্তী। একক অভিনয়ে দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন মোমেনা চৌধুরী।
মঞ্চ নাটকের উল্লেখযোগ্য সময় ছিল বিংশ দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত। এসময়ে নাটকের বিষয়বস্তু যেমন ছিল, তেমন এর সঙ্গে জড়িত নিদের্শক ও নাট্যকারও ছিলেন অনেক উচ্চমানের। যে কারণে কোন কোন নাটক ২০০-৪০০ বার মঞ্চায়ন হলেও দর্শকের কাছে পুরানো হয়ে যায়নি। বর্তমান সময়ে তেমন উল্লেখযোগ্য নাটক মঞ্চায়ন হতে দেখা যায় না। যাও বা কিছু হচ্ছে তা তেমন ভাবে দর্শকদের টানতে পারছে না। তেমনই কিছু নাটকের মধ্যে রয়েছে, নাগরিক নাট্যাঙ্গনের নাটক ‘গহর বাদশা ও বানেছা পরী’। নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন হৃদি হক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রাধাকৃষ্ণ’ উপন্যাস অবলম্বনে রচিত হয়েছে ‘প্রনয় যমুনা’। নাট্যরূপ দিয়েছেন আসাদুল ইসলাম। সুবচন নাট্য সংসদের এ নাটকটিতে নির্দেশনা দিয়েছেন সুদীপ চক্রবর্তী সুবচন। এ ছাড়া থিয়েটার আর্ট ইউনিট এর নাটক ‘মর্ষকাম’। নাটকটি রচনা করেছেন আনিকা মাহিনি একা এবং নিদের্শনা দিয়েছেন রোকেয়া রফিক বেবী।
সভ্যতা যত এগিয়ে যায়, জীবন জীবিকার ধরণ তত সহজ হয়ে যায়। কার কারণে মানুষ আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক আবিস্কারে মনোনিবেশ করে। সেক্ষেত্রে শিল্প এবং সাহিত্য অত্যাধুনিকের নামে পিছিয়ে যাচ্ছে। আগের মতো নাটক-সাহিত্য জনমনে প্রভাব ফেলতে পারছে না। এর কারণ বোধ করি অসংখ্য বিনোদন মাধ্যম। তবুও বলবো বিনোদনের মাধ্যম নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। কোন মাধ্যম অন্য মাধ্যমকে অস্বীকার করতে পারে না। মঞ্চ নাটকের গ্রহণযোগ্যতা অতীতে যতটা ছিল, বর্তমানেও তার বিন্দুমাত্র কমেনি বলে আমার ধারনা। তবে নাট্য রচয়িতা এবং নির্দেশক মনোযোগ হারিয়েছেন বলে আমি মনে করছি। (সমাপ্ত)
(www.theoffnews.com - Bangladesh stage drama)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours