পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
প্রায় দুই যুগ আগেকার একটা গল্প দিয়ে এই লেখাটা শুরু করা যেতেই পারে। চৌরঙ্গীর পিয়ারলেস ইন হোটেলে ইন্টারভিউ চলছে ইটিভির। সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী নেওয়া হবে। এর আগে আরও তিন দফা ইন্টারভিউ হয়ে গিয়েছে, এটিই ফাইনাল। হায়দরাবাদ থেকে ইটিভি নিউজের প্রধান এস আর রামানুজন এসেছেন প্রাথমিক বাছাই প্রার্থীদের থেকে সফলদের বেছে নিতে। আমার বয়স তখন খুব বেশি নয়। রীতিমত টেনশনে আছি, অন্যদেরও একই অবস্থা দেখে মনে হল। এক সময় ডাক এল। রামানুজনের সঙ্গে বসে ছিলেন আশিস ঘোষ। আশিষদার সঙ্গে ইতিমধ্যেই দেখা হয়েছে। আমায় দেখে খুব আন্তরিক স্বরেই কথা বলেছিলেন ওরা। আশিসদা শুধু আস্তে করে ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্টের কথাটা জানিয়ে দিলেন। শুনেই রামানুজন স্যার বললেন খুব ভাল, তুমি যে কোনও খবরে গিয়ে সমস্যায় পড়লে মোকাবিলা করবে, যা খুশি খবর করবে, ভয় পাবে না, বাকিটা আমরা সামলে নেব। কথাটা খুব মনে ধরেছিল আমার। সাহস পেয়েছিলাম, মনোবলটাও এক লাফে অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল।
আজ কিন্তু এভাবে কেউ খবর করতে বলেন না। আমাদের কিন্তু প্রথম দিকে কোনও দিন বলা হয়নি বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দলের হয়ে খবর করতে। জিজ্ঞাসা করা হয়নি, কেন এই খবর আমরা করেছি। জেলা থেকে খবর গেলে সাংবাদিকের কথাই চূড়ান্ত ছিল তখন। ইটিভির প্রথম পাঁচ ছটি বছর আমার কাছে খবরের স্বর্ণযুগ। নিরপেক্ষ খবর, বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা দারুণ দারুণ সব তদন্তমূলক, বিশ্লেষণধর্মী, চমকে দেওয়ার মত খবরের ছড়াছড়ি। ইন্সিডেন্টের পাশাপাশি কে কত ভাল স্টোরি করতে পারে তার একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা। বেশ ভালই কাটছিল। গোল বাঁধল বছর ছয়েক পরে। আসলে এতদিন খবরের চ্যানেল দেখাশোনা বা তার তদারকি করতেন খবরের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। এবার এই দায়িত্বে এলেন কিছু ম্যানেজার। তারা অধিকাংশই অল্পবয়স্ক, এম বি এ পাশ করা ঝকঝকে ছেলে, কিন্তু খবরের মানুষ নন। তারা এসেই সংবাদকে অংকের চাদরে মুড়ে ফেললেন। সাংবাদিকদের কে কতগুলি খবর করছেন তা সংখ্যা দিয়ে মাপা শুরু হল। জারি হল ফতোয়া, দিনে অন্তত দুটি খবর, মাসে ষাটটিরও বেশি খবর করতেই হবে। ব্যস… যে সাংবাদিক মাথা খাটিয়ে, গবেষণা বা পড়াশোনা করে, বিভিন্ন খোঁজ খবর নিয়ে ভাল ভাল খবর করতেন, তারা তখন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নম্বর বাড়াতে। কারন ভাল স্টোরি করতে গেলে এক এক সময় তিন চার দিন বা তার বেশিও লেগে যেত হোমওয়ার্ক করতে। সেই সময়টুকু দিতে নারাজ তথাকথিত ম্যানেজাররা। শুরু হয়ে গেল সাইকেলের সঙ্গে অটোরিকশার ধাক্কা, পাড়ায় রক্তদান শিবির, শাশুড়ি বৌমার মারামারির মত সহজলভ্য খবরের বন্যা। লক্ষ্য শুধু কোটা ভরানো।
এখনও জারি সেই ট্র্যাডিশন। কারণ এর পরেই সংবাদ মাধ্যমে বিশেষ করে বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমে নতুন চ্যানেল নিয়ে আসার সাহস করেন ছোট খাটো ব্যবসায়ীরা। তাদের পুঁজিও ছিল কম, যে কোনও খবর করবার সাহসও ছিল শূন্য। তাই সরকারের বিপক্ষে খবর বা বড় ব্যবসায়ী বা প্রভাবশালীদের বিপক্ষে খবর প্রায় উঠে যেতে বসল। প্রায় বললাম তার কারণ, কখনও সখনও ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক কারনে এই মালিকরাই হঠাৎ সাহসী হয়ে উঠতেন। কিন্তু সংবাদকর্মীদের ঠিকঠাক বেতন না দেওয়া, তাদের অতি স্বল্প বেতনে দশ ঘন্টা বা তারও বেশি সময় কাজ করিয়ে নেওয়া। ইন্টার্নশিপের নামে বিনা বেতনে অল্পবয়সীদের অমানুষিক খাটানো। এগুলি এই আমল থেকেই শুরু। শুধু ছোট গোষ্ঠীকেই বা দোষ দেব কেন, রিলায়েন্সের মত দেশের সব চেয়ে বড় সংস্থা যখন টিভি চ্যানেল করে তখন বাংলা চ্যানেলের মাথায় বসানোর জন্য তারা মুখ্যমন্ত্রী অনুগামী কোনও সাংবাদিককেই খোঁজে, নিরপেক্ষ কাউকে নয়।
এখন তাই কোনও চাকরির ইন্টারভিউতেই বলা হয় না, যা খুশি খবর কর, আমরা দেখে নেব। এই বুকের পাটাটাই নেই কারও। পরের দিকে আমি নিজেও পারিনি। কারন কোনও চ্যানেলে যোগ দেওয়ার সময়েই জেনে যেতাম সেই চ্যানেল কোন রাজনৈতিক দল বা ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে সমর্থন করছে বা করবে। তাই নির্দিষ্ট পক্ষের হয়ে দাঁড়িয়ে জনসমক্ষে নিরপেক্ষ থাকার অভিনয়টাই শুধু করে যেতে হত, হয়। আজ যখন রণে বনে জলে জঙ্গলে হাটে বাজারে প্রতি পদে শুনি যে সংবাদ মাধ্যম বিকিয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে খুব জোরে প্রতিবাদ করতে পারি না।
কিন্তু এটাও ঠিক। এটা একটা ইন্ডাস্ট্রি, এখানে অসংখ্য মানুষ কাজ করেন। তাদের পরিবার পরিজন মিলিয়ে আরও অনেক সংখ্যা। তাই একে বাঁচাতে গেলে কিছুটা ব্যবসায়িক হতেই হয়। এই টিকিয়ে রাখার দায় থেকেই চলে আসে জনপ্রিয় হওয়ার হিসেব। আসে টিআরপি নামক অতি সাংঘাতিক একটা শব্দ। এই শব্দই এখন নিয়ন্ত্রণ করে সংবাদ মাধ্যম তথা গোটা ইন্ডাস্ট্রিকে। এখানেই সংবাদ কর্মীদের পাশাপাশি জড়িয়ে গিয়েছেন তাদের সমালোচনা করা সাধারণ মানুষজনও। কোনও অনুষ্ঠান (খবর, সিরিয়াল বা যে কোনও শো) জনপ্রিয় হয় দর্শকের চাহিদার উপরে। টার্গেট রেটিং পয়েন্ট (টিআরপি) স্থির হয় কত সংখ্যক সাধারণ মানুষ কোন অনুষ্ঠান বা খবর বেশি দেখছেন তার উপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ যার টিআরপি বেশি, তার দর্শক সংখ্যা বেশি, তার বিজ্ঞাপনও বেশি, রোজগারও বেশি। অর্থাৎ সাধারণ দর্শকই ঠিক করে দেন কি ধরনের অনুষ্ঠান তারা চান।
কেউ কেউ দাবি করেন খবর তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা ঠিক কথা নয়। বরং তারাই খবর কি হবে সেটা সংবাদকর্মীদের উপরে চাপিয়ে দেন। একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক। সম্প্রতি এক অভিনেত্রী সাংসদের মা হওয়া নিয়ে তোলপাড় বাংলা সংবাদ মাধ্যম। সন্তান কার, বিবাহ বিচ্ছেদের আগেই এই সন্তান কেন, অভিনেত্রীর কার সঙ্গে অন্য সম্পর্ক রয়েছে, কেন ভাঙল বিয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তলিয়ে দেখুন তো… এই খবর যদি আপনি আমি না খেতাম তাহলে আমাদের বার বার গেলানো সম্ভব ছিল, না দরকার ছিল? খবরের কাগজে সে ভাবে বোঝা যায় না। কিন্তু টেলিভিশনে এই খবরের টিআরপি বোঝা যায়, এখনকার ডিজিটাল মিডিয়ায় আপনি এই খবর কতবার দেখছেন তা সহজেই গোনা যায়। এবার যদি প্রথম কদিনেই দেখা যেত সাধারণ মানুষ এই খবর পছন্দ করছেন না, তাহলে কোনও সংবাদ মাধ্যমের দায় ছিল না তা দেখানোর বা প্রকাশ করবার। টিভিতে কয়েকজন বসে যে আলোচনা বা বিতর্ক হয় তারও সমালোচনা করতে দেখেছি অনেককেই। কিন্তু ওই অনুষ্ঠানের টিআরপি কিন্তু বেশ বেশি। অর্থাৎ সমালোচনা করলেও লোকে কিন্তু দেখছে, তাই সেই অনুষ্ঠান, খবর বা তার ফলো আপই প্রাধান্য পাচ্ছে। অর্থাৎ খবরের মান ঠিক করবার ক্ষেত্রে আপনার দায়ও কিছু কম নয়।
কিন্তু এসব স্বত্বেও সংবাদ মাধ্যমের দায়িত্ব অস্বীকার করা যায় না। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের এই নড়বড়ে দশার জন্য তাদের নিজেদেরও যথেষ্ট অবদান রয়েছে। যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা সংবাদ মাধ্যম, তাদের কর্মী সাংবাদিকদের ন্যুনতম শিক্ষার অভাব, সংবাদ মাধ্যমের অতি স্বল্প বেতনে প্রচুর পরিশ্রম করিয়ে নেওয়ার প্রবণতা, এগুলি না গেলে এই পেশায় ভাল ছেলেমেয়েরা আসতেই চাইবে না। মান কমবে, কমবে নামও। দোষারোপের পালা ছেড়ে আমরাই পারি আমাদের সংবাদমাধ্যমকে ফের সুস্থ করে তুলতে। আপনি আমিই পারি আমাদের চাওয়ার ক্ষেত্রটিকে ইতিবাচক পর্যায়ে নিয়ে যেতে। তাহলেই হয়তো টিআরপির ঘেরাটোপ ছেড়ে স্বমহিমায় ফের জেগে উঠতে পারে বাংলার সংবাদ মাধ্যম।
(www.theoffnews.com - media house TRP reporter)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours