তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

এবার আসি বহুল প্রচলিত একটা প্রশ্নে। জল নাকি পানি: মাসুদ পথিকের কথায় ‘মনে মনে ভাবি, এই কান্নায় কি ঝরে বেশি জল না পানি?' লালনের ভাষায় ‘জলের উপর পানি না পানির উপর জল?’ কিন্তু জল ও পানি নিয়ে ছুঁতমার্গ ঠিক কবে থেকে শুরু হল এই বাংলায়? বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদে দেখি, ‘তেন ন চ্ছুপই হরিণা পিবই ন পাণী।’ (ভুসুকপা)। বড়ু চণ্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন-এ জল ও পানি শব্দ দুটি পাশাপাশি ব্যবহার করেন, ‘তোহ্মার বোলে কেহো কাহ্নাঞি না বহিব পাণী।/ উচিত নিফল হৈব তোর জল ভাবি বুঝ চক্রপাণী।।’ (যমুনাখণ্ড)

মধ্যযুগের কবিরা অবলীলায় চয়ন করছেন এই পানি/পাণি/পাণী/জল শব্দ। চণ্ডীমঙ্গলে আছে, ‘বিরহ-জ্বরে পতি যদি মরে/ কোন ঘাটে খাবে পাণী/ কাঁখে হেমঝারি মেনকা সুন্দরী/ জল সাধে ঘরে ঘরে’ (কবিকঙ্কণ)। চৈতন্যমঙ্গলে, ‘এ বোল শুনিয়া পুনঃ প্রভু বিশ্বম্ভর। কান্দয়ে দ্বিগুণ ঝরে নয়নের জল।।’ এবং ‘মুখে নাহি সরে বানী/ দু নয়নে ঝরে পানি...’ (লোচনদাস)।

অতএব সাম্প্রদায়িকতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখুন। বিভেদ ভুলুন। বাংলা ও বাঙালি এগিয়ে যাক। মাতৃভাষা আজ আগ্রাসনের মুখে। এখন অনেকেই বলছেন ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম মাতৃভাষা আবার কি। মানুষ ভাষা বুঝলেই তো হলো। তাই আজকের প্রতিবেদনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মনে রাখবেন বন্ধুরা প্রথমে আধিপত্যবাদীরা আগে ভাষাকে আক্রমণ করে। তারপর যে মানুষ গুলো ওই ভাষার সাথে জড়িত তাদের পদদলিত করে। এটাই ইতিহাস আমাদের শিক্ষা। তাই মাতৃভাষা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কি বলেছেন আর একবার দেখা যাক। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির জীবনাচরণকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন৷ তাঁর ভাবনার বলয়ে আবর্তিত হয়েছে বাংলা ও বাঙালির যাবতীয় অনুষঙ্গ৷

রবীন্দ্রনাথের মননে প্রোথিত বিষয়াবলির মধ্যে অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ছিল বাংলাভাষা৷ মাতৃভাষা বাংলার সপক্ষে ছিল তাঁর আজন্ম সংগ্রাম৷ তাঁর বহু প্রবন্ধে, চিঠিপত্রে তার পরিচয় পাওয়া যায়৷ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে রবীন্দ্রনাথ মাতৃভাষা বাংলার প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন৷ মাত্র বাইশ বছর বয়সে ‘ভারতী' পত্রিকায় তিনি লিখেছেন, ‘‘ইংরাজিতে যাহা শিখিয়াছ তাহা বাংলায় প্রকাশ কর, বাংলা সাহিত্য উন্নতি লাভ করুক ও অবশেষে বাংলা বিদ্যালয়ে দেশ ছাইয়া সেই সমুদয় শিক্ষা বাংলায় ব্যাপ্ত হইয়া পড়ুক৷''

মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে বাংলাদেশে সকল প্রকার শিক্ষার ব্যবস্থা করা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চিরজীবন উদ্বিগ্ন ছিলেন৷ বঙ্গাব্দ তেরোশো'র আষাঢ় সংখ্যায় তিনি শিক্ষায় মাতৃভাষার স্থান সম্বন্ধে যা বলেছিলেন তা এখনো উদ্ধৃতিযোগ্য – ‘‘কোন শিক্ষাকে স্থায়ী করিতে চাইলে, গভীর করিতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে তাহাকে চিরপরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়৷''

বাংলা ভাষার রূপ ও প্রকৃতি, অবয়ব এবং আন্তরশক্তি অবলোকন ও অনুসন্ধানে ছিল তাঁর নিরন্তর আগ্রহ৷ শুধু ভাব প্রকাশের বাহন নয় বাংলা ভাষাকে জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন চর্চার বাহন হিসেবে পেতে হলে, তিনি বলেছেন, ‘‘বাংলাভাষাকে চিনতে হবে ভালো করে; কোথায় তার শক্তি, কোথায় তার দুর্বলতা, দুইই আমাদের জানা চাই৷'' তিনি চেয়েছিলেন বাংলাভাষা যেন সবল ও সতেজ হয়৷

বঙ্গাব্দ তেরোশো' এগারোতে তিনি 'ভাষার ইঙ্গিত' প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘‘বৈয়াকরণের যে সকল গুণ ও বিদ্যা থাকা উচিত তাহা আমার নাই, শিশুকাল হইতে স্বভাবত আমি ব্যাকরণভীরু; কিন্তু বাংলা ভাষাকে তাহার সকল প্রকার মুর্তিতেই আমি হৃদয়ের সহিত শ্রদ্ধা করি, এই জন্য তাহার সহিত তন্নতন্ন করিয়া পরিচয় সাধনে আমি ক্লান্তিবোধ করি না৷''

রবীন্দ্রনাথের এই শ্রদ্ধার প্রতিরূপ হলো তাঁর দুই অসামান্য গ্রন্থ ‘বাংলাভাষা-পরিচয়' ও ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব'৷ ঠাকুরবাড়িতে মাতৃভাষার চর্চা ছিল সবার আগে, কিন্তু ইংরেজী ভাষাকেও সেভাবে অবজ্ঞা কিংবা উপেক্ষা করা হয়নি। বাল্যকালীন এসব স্মৃতি কবিকে এত তাড়িত করে যে বিদ্যাশিক্ষায় মাতৃভাষার কোন বিকল্প নেই এ কথা বার বার স্মরণ করিয়ে দেন আমাদের। ইংরেজী সাহিত্যের প্রতি দরদ, জানার আগ্রহ ঠাকুরবাড়ীর সমৃদ্ধ পরিবেশে বেড়ে ওঠা কবির চিরদিনের। বাংলায় লেখা গীতাঞ্জীলকে কবি ভাষার রূপান্তর এই ‘সং অফারিংস’ই কবিকে নিয়ে যায় বিশ্ব পরিসরের শ্রেষ্ঠ আসনে। সারা ইউরোপব্যাপী আলোড়ন তোলে কবির এই ইংরেজী লেখা ‘সং অফারিংস’। ‘গীতাঞ্জলী’তে ইংরেজী সাহিত্যের মূল সুর, ভাষা এবং শব্দচয়ন সেভাবে যদি ঝংকৃত না হতো তাহলে ইংরেজ কবি ইয়েটসকে কি অতখানি মুগ্ধ করতে পারত? শুধু কি বিশ্বজয়? সেদিন কবি বাংলা ও বাঙালীকে বিশ্বের দরবারে দাঁড় করিয়েছিলেন, চিনিয়ে দিয়েছিলেন। তার মূল্য তো কোন কিছুর বিনিময়ে হতে পারে না? তাই ইংরেজী ভাষার প্রতি কোন ক্ষোভ কবির কখনই ছিল না। আমরা এও জানি ‘ঞযব পযরষফ’ কাব্যটি প্রথমে ইংরেজিতে লেখা হয়। পরে কবি নিজেই সেটাকে বাংলায় রূপান্তর করেন।

কিন্তু শিক্ষার শুরুতে দেশীয় পরিবেশ, নিজের মুখের ভাষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া অত্যাবশ্যক। এ প্রসঙ্গে ‘শিক্ষা প্রবন্ধে কবির অভিমত

‘একে তো ইংরেজী ভাষা অতিমাত্রায় বিজাতীয় ভাষা। শব্দ বিন্যাস, পদ বিন্যাস সম্বন্ধে আমাদের ভাষার সহিত তাহার কোন প্রকার মিল নাই। তাহার পরে আবার ভাব বিন্যাস এবং বিষয় প্রসঙ্গও বিদেশী। আগাগোড়া কিছুই পরিচিত নহে, সুতরাং ধারণা করিবার পূর্বেই মুখস্থ করিতে হয়। তাহাতে না চিবাইয়া গিলিয়া খাইবার ফল হয় (র. র. ষষ্ঠ খ-, ‘শিক্ষা’, পৃঃ ৪৬৬)।’

এই নাজুক অবস্থা থেকে কবি নিজেই জীবনভর সতর্ক ছিলেন। আমাদেরও এই দুরবস্থার থেকে বের করে আনার পরামর্শ দিয়েছেন। আর তাই শিক্ষার শুরু থেকে মাতৃভাষাকে প্রধান মাধ্যম হিসেবে বিবেচনায় এনেছেন। পাশাপাশি বিদেশী ভাষাকে বর্জনের কথাও কখনও বলেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ।

সর্বপ্রথমে বলে রাখি আমার স্বভাবে এবং ব্যবহারে হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব নেই। দুই পক্ষেরই অত্যাচারে আমি সমান লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ হই এবং সে রকম উপদ্রবকে সমস্ত দেশেরই অগৌরব বলে মনে করে থাকি। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Bengali language Rabindranath Tagore terrorism)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours