দেবিকা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও লেকচারার, চন্দননগর, হুগলি:

পিতা ছিলেন বিলেতি শিক্ষায় শিক্ষিত সুদৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ। পাকা ইউরোপীয় আদর্শে পুত্রকে মানুষ করতে দার্জিলিঙে 'আইরিশ নান্'দের স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। পরে ইংল্যান্ডে একজন পাদ্রী এবং তাঁর স্ত্রীর তত্ত্বাবধানে পুত্রকে রেখে এসেছিলেন। পাঁচ থেকে কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর বাংলা ভাষার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। পুত্র গ্রীক, ল্যাটিন, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষাতে ভালো রকম ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন আর জার্মান, ইটালিয়ান ও স্প্যানিশ ভাষা খানিকটা শিখেছিলেন।স্কুলের পাঠ্য বিষয় আয়ত্ত করতেন খুব অল্প সময়ে। ল্যাটিন ও গ্রীক কবিতা লিখে কিংস কলেজে এক বছর সব পুরস্কার জিতে নেন বালকটি। বাংলা ভাষা শেখার সুযোগ না থাকলেও তাঁর পিতা তাঁকে"The Bengalee" কাগজ পাঠাতেন দাগ দিয়ে, যাতে ইংরেজের দ্বারা ভারতীয়ের নির্যাতনের কথা থাকত আর চিঠিতে ঐসব উল্লেখ করে বলতেন, ভারতে যে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট আছে তা নিতান্ত হৃদয়হীন। মাত্র এগারো বছর বয়সেই একটা স্পষ্ট ধারণা হয়েছিল যে, জগতে সাধারণভাবে একটা জোর বি‍প্লব আসবে এবং তাতে বিশেষ অংশগ্রহণ করতে হবে পিতৃদত্ত নামের অরবিন্দ অ্যাক্রয়েড ঘোষকে। পরে 'অ্যাক্রয়েড' শব্দটি নাম থেকে নিজে পরিত্যাগ করেন ঋষি অরবিন্দ ঘোষ।

আজ পাঁচটি দেশের স্বাধীনতা দিবস এবং শ্রীঅরবিন্দের জন্মদিবস। তাঁর জীবন ঘিরে অজস্র গল্প। নিজের জীবনের ইতিহাস বিশদভাবে না লিখলেও নানা পত্রিকা, পুস্তিকায় নানান ভুল কথা যখন প্রচারিত হতে থাকে তখন অরবিন্দ আশ্রম থেকে 'নিজের কথা' নামে এক প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যেখানে অরবিন্দের লেখা সংকলিত হয়েছে এবং যা পাঠ করলে আমরা অনেক ভুলভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারি।

পণ্ডিচেরী আশ্রমে যখনই গেছি কী এক প্রশান্তিতে মন ভরে উঠেছে। এ অভিজ্ঞতা শুধু আমার একার নয়, যাঁরা আশ্রমে একবার অন্তত গিয়েছেন তাঁরা সকলেই একথা জানেন। আশ্রমে একবার 'শিক্ষা' নামক এক পুস্তিকার অনেকগুলি কপি আমি কেনার জন্য বাছাই করে রাখি। পাঠাগারের একজন সেটি খেয়াল করেন এবং জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকেন আমার এতগুলি পুস্তিকা নেওয়ার কারণ। আমার ছাত্র ছাত্রীদের একখানি করে দেব, এই কথা শুনে ওনারা আমার নামধাম পরিচয় জানতে চাইলেন। আমি তখন সত্যিই লজ্জিত এবং কুণ্ঠিত। তেমন কোনো বিশেষ পরিচয় আমার তো নেই! আলিপুর বোমার মামলা, ঋষি অরবিন্দ, স্বাধীনতা সংগ্রাম এমন টুকরো টুকরো নামের সঙ্গে আমার পরিচয় পুঁথিগত দিক থেকে। পণ্ডিচেরীর আশ্রমে এত জন সমাগম! মাথা নত করে, নীরব হয়ে সবাই যেন ধ্যানমগ্ন। কীসের জন্য! কিচ্ছু বুঝি না আমি কিন্তু বুঝতে চাই, জানতে চাই। পাঠাগারের সমস্ত গ্রন্থ নেড়ে চেড়ে জানার আকাঙ্ক্ষা আমার, কী আছে এতসব গ্রন্থে, কীসের জন্য মানুষ এমন সমাহিত! সেখানেই দাঁড়িয়ে 'শিক্ষা' পুস্তিকাটি চট করে পড়ে মনে হয়েছে, আমার ছাত্র ছাত্রীদের হাতে তুলে দিলে পড়তে পড়তে তারা নিজেদের মনে বাস্তবিক শিক্ষার আলো জ্বালাতে পারবে। কিন্তু আমার নিজের পরিচয়! কুণ্ঠিত আমি নীরব হয়েই দাঁড়িয়ে থাকি। তবু ওনারা শিক্ষিকার মর্যাদা দিয়ে আমার কেনা গ্রন্থগুলির উপর বিশেষ ছাড় দিলেন এবং সঙ্গে অরবিন্দের 'নিজের কথা' গ্রন্থখানি দিলেন। আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। এ গ্রন্থ পাঠ করার সুযোগ না ঘটলে অরবিন্দ সম্পর্কে অনেক কথা অজানা থেকে যেত।

চন্দননগর যেমন কানাইলাল দত্ত, রাসবিহারী বসুর মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীর জন্ম দিয়েছে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামীকে চন্দননগর আশ্রয় দিয়েছে। ফরাসি অধিকৃত চন্দননগরে ব্রিটিশ পুলিশের বাধা-নিষেধ থাকায় অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী পুলিশের চোখে ধুলো দিতে চন্দননগরে এসে আত্মগোপন করতেন। তেমনই এসেছিলেন ঋষি অরবিন্দ। 'নিজের কথা' অনেক অজানা বিষয়ে আলোকপাত করে। বিশেষ করে তাঁর চন্দননগরে আসার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে। এ ব্যাপারে নিবেদিতার কোনো যোগ ছিল না। 

শ্রী অরবিন্দের শ্রুতলিপি অনুসারে অরবিন্দ আশ্রমের সেক্রেটারি বিবৃতি দেন যে, ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে অরবিন্দের চন্দননগরে আসা একটা আকস্মিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফল। ভগিনী নিবেদিতার কথায় তিনি এখানে আসেননি।আসার আগে সারদামণির দর্শন লাভের জন্য বাগবাজার মঠেও যাননি তিনি। খুব দ্রুত গতিতে, সঙ্গোপনে 'ধর্ম্ম' অফিস থেকে সোজা ঘাটে গিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন রাম মজুমদার। সুরেশ চক্রবর্তী ও বীরেন ঘোষও তাঁদের অনুসরণ করতে থাকেন এবং নৌকা ডাকা হলে অরবিন্দ সহ অন্য তিনজনেই নৌকায় ওঠেন। নিবেদিতাকে পরেরদিন এ খবর জানানো হয় কারণ অরবিন্দের অবর্তমানে 'কর্মযোগীন' পত্রিকাটির দায়িত্ব নিবেদিতাকে নিতে হয়। 

চন্দননগরে মতিলাল রায় বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। তাঁর স্ত্রী রাধারানি রায়ও যোগ্য সহধর্মিনী। অনাথ আশ্রম, ছাত্রাবাস তৈরি বহু সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত রেখেছেন আজীবন। বহু বিপ্লবী মতিলাল রায়ের গৃহে আশ্রয় নিতেন। ঋষি অরবিন্দ ঘোষ মতিলাল রায়ের কাছেই আত্মগোপন করে ছিলেন। চন্দননগরে যাঁর কাছে আশ্রয় নেওয়ার কথা ছিল অরবিন্দর, যে কোনও কারণেই হোক তিনি অরবিন্দকে আশ্রয় দিতে রাজি হন না। তখন আশ্রয়হীন অবস্থায় নৌকায় বসে থাকেন অরবিন্দ।খবর পেয়ে মতিলাল রায় অরবিন্দকে নিয়ে যান তাঁর বাড়িতে। আশ্রয় দেন। এক মাসেরও বেশি সময় তিনি ছিলেন চন্দননগরে। তবে শুধু মতিলালের বাড়িতেই নয়, চন্দননগরে আরও তিন–চারটি গোপন ডেরায় ঘুরে ফিরে থাকতেন অরবিন্দ ঘোষ। এই সময়েই মতিলালের সঙ্গে অরবিন্দের একটা দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

১৯১০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে অরবিন্দ চন্দননগর থেকে 'যতীন্দ্র মিত্র' ছদ্মনামে চাঁদপাল ঘাট থেকে 'ড্যুপ্লে' জাহাজে পন্ডিচেরীতে চলে যান আর মে মাসে অরবিন্দ একটি চিঠি পাঠান মতিলালকে। সেই চিঠি খুলে মতিলাল দেখেন সেখানে একটি কাগজের মধ্যে পেন্সিল দিয়ে তিনটি মন্ত্র লেখা। এই তিনটি মন্ত্রই হল মতিলালের দীক্ষা। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, যেদিন এই চিঠি মতিলাল পান, সে দিনটা ছিল অক্ষয়তৃতীয়া। এই ঘটনার স্মরণে মতিলাল ১৯২৩ সাল থেকে চন্দননগরে অক্ষয়তৃতীয়া উৎসবের সূচনা করেন। এই ব্যাপারে অবশ্য 'নিজের কথায়' কোনো বিবৃতি পাওয়া যায়নি।

মতিলাল রায়ের গড়া প্রবর্তক আশ্রমে কোনো এক সময়ে পড়ানোর সুযোগ পাওয়ায় মতিলাল রায়ের কর্মকাণ্ডের কিছু আভাস পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়। মোতিলালের বাড়ির সীমানার একটি অংশে অরবিন্দ ট্রাস্ট গড়া হয়েছে। ভিতরে পণ্ডিচেরীর অরবিন্দ আশ্রমে নির্মিত অরবিন্দের সমাধি বেদীর আদলে সমাধি বেদীর এক ক্ষুদ্র সংস্করণ রয়েছে। অরবিন্দের চিতাভস্ম এনে এই বেদী নির্মিত। 'অরবিন্দ ট্রাস্ট' স্মৃতি রক্ষার চেষ্টা করে চলেছে।

অরবিন্দ চেয়েছিলেন এক বিশ্ব-মিলন। যাতে সমগ্র মানবকুলের একটা সুন্দরতর, উজ্জ্বলতর এবং মহত্তর জীবনের ঐক্যযুক্ত বাহ্য ভিত্তি গড়ে উঠবে। চেয়েছিলেন ভারত হবে স্বাধীন এবং ঐক্যবদ্ধ। ভারত স্বাধীন হলেও ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। দেখেছিলেন অন্য এক স্বপ্ন। ভারত জগতকে দেবে তার বহুমূল্য আধাত্মিক জ্ঞানের অবদান। তিনি শিখিয়েছেন "চিন্তামাত্র প্রত্যাখান" করলে ধ্যান সহজ হয়। মনকে শান্ত করতে হলে —"আগে মনকে নীরব করতে হবে।"

বিবর্তনের ক্ষেত্রে মানুষ উচ্চতর, বৃহত্তর চেতনা পেয়ে আজ পর্যন্ত যে সমস্যার উত্তর সে খুঁজে পায়নি তার মীমাংসা আসবে। যে কোনো অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সাধনা দরকার, আর— "সাধনার পক্ষে সবচেয়ে খারাপ জিনিস হলো মনমরা হয়ে কেবল যত নিম্নশক্তিদের আক্রমণ প্রভৃতি নিয়েই ভাবতে থাকা। সাধনা যদি কিছু সময়ের জন্য থেমেও যায়, তা হোক, তুমি নীরব হয়ে সাধারণ কাজগুলো করে যাও, বিশ্রাম দরকার হলে বিশ্রাম করো, —দেহচেতনা প্রস্তুত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো।"

(www.theoffnews.com - Indian Independence Day)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours