পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
কি মনে হয়? পেট্রোল ডিজেলের দাম কি আর কমবে? কোটি টাকার এই প্রশ্নটা ছাপিয়ে কিন্তু বাজারে ঘুরছে আরও একটা প্রশ্ন। জ্বালানি তেলের এই উর্দ্ধগতির কি আদৌ শেষ আছে? দেশের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী কিন্তু সাফ জানিয়ে দিয়েছেন জ্বলানি তেলের দাম কমানোর বিষয়ে তারা নাকি এখনই কিছু ভাবছেন না। কারণ পেট্রোপণ্য থেকে রোজগার হওয়া ৩৫ হাজার কোটি টাকা নাকি গত এক বছরে খরচ করা হয়েছে দেশে টিকা প্রদানের জন্য। অথচ পেট্রোপণ্যের দুটি শুল্ক থেকে গত অর্থবর্ষে কেন্দ্রের আয় হয়েছে সাড়ে চার লক্ষ কোটি টাকা। বাকি টাকার হিসেব অবশ্য পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী দেননি। আর দেশে টিকা প্রদানের হাল তো আমাদের সকলেরই জানা।
করোনা কালে নাজেহাল জনতার টিকে থাকার লড়াইয়ে ফি দিন কাটা ঘায়ে নুনের প্রলেপ লাগিয়েই চলেছে সরকার। অসহায় মানুষের দুর্দশার প্রতি দৃশ্যতই ধৃতরাষ্ট্র দুই সরকারই। কারন কেন্দ্র এবং রাজ্যের চাপানউতোরের মধ্যেই নির্বিঘ্নে বেড়ে চলেছে তেলের দাম। দুপক্ষের কেউই কিন্তু তা কমানোর ব্যাপারে উৎসাহী নয়। রাজ্য কয়েক মাস আগে এক টাকা শুল্ক কমালেও সেই দিনই কেন্দ্র শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়ায় তার সুফলটুকুও মেলেনি। বার বার বলা হচ্ছে পেট্রোপন্যকে জিএসটির আওতায় নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু এই বিষয়ে কেন্দ্র অথবা রাজ্য, দুই সরকারই চুপ।
কেন্দ্র শুরু থেকেই বলে আসছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণেই জ্বালানির দাম বেড়েছে। সেই সঙ্গে রাজ্য সরকার যে কর নেয়, সেটাও দাম বাড়ার কারণ বলে জানিয়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু দেখা দরকার ২০১৩ সালের জুনে গড় ক্রুড অয়েলের দাম যখন ব্যারেল পিছু ১০১ ডলার, তখন ভারতের পেট্রোল খুচরো বাজারে বিক্রি হয়েছে লিটার পিছু কমবেশি ৬৩ টাকায়। একই ভাবে ২০১৮-র অক্টোবরে যখন ক্রুড অয়েলের দাম ছিল ব্যারেল পিছু ৮০.১ ডলার (১ ব্যারেল = ১৫৯ লিটার), তখন ডিজেলের দাম ছিল লিটার পিছু ৭৩ টাকার আশেপাশে।
এখান থেকেই স্পষ্ট, আমাদের দেশে তেলের দাম বিশ্ববাজারে ক্রুড অয়েলের দাম বাড়ার উপরে মোটেই নির্ভরশীল নয়। কারণ যখন অশোধিত তেলের দাম তুলনায় বেশি, তখন পেট্রোল-ডিজেলের দাম কম, আবার কখনও উল্টোটা। তেলের মূল্যবৃদ্ধির মূলে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের কর। দেখা যাচ্ছে তেলের দাম এই যে রেকর্ড উঁচুতে, তার জন্য দায়ী ওই করের কামালই, যদিও কেন্দ্র ও রাজ্য দুই পক্ষই ক্রুড অয়েলের আড়াল করতে করতে চায় নিজেদের। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকার। তাই তো গত বছর ক্রুড অয়েলের মূল্য শূণ্যের নিচে নেমে যাওয়ার পরেও আমরা কিছুই টের পাইনি কেন্দ্রের বদান্যতায়। বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমেছে, পাল্লা দিয়ে উৎপাদন শুল্ক বাড়িয়েছে কেন্দ্র। ২০২০ সালে প্রখর অতিমারীতে যখন নাভিশ্বাস উঠছে, তখন কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রোলে শুল্ক বাড়িয়েছে লিটার পিছু ১৩ টাকা, ডিজেলে ১৬ টাকা। রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ, অসম, মেঘালয়ের মতো কয়েকটি রাজ্য তেলের করে সামান্য কাটছাঁট করলেও, কেন্দ্র শত চাপেও সে পথে হাঁটেনি। এমনকি আরবিআই মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য কর ছাঁটাই করতে কেন্দ্রকে বললেও তারা কান দেয়নি।
একই কথা প্রযোজ্য রান্নার গ্যাসের ক্ষেত্রেও। চুপচাপ গ্যাসের ভর্তুকি আগেই তুলে দিয়েছে কেন্দ্র। সাধারণ মানুষের অসহায়তা বাড়াতে গ্যাসের দামও এখন গগনচুম্বী। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে যে গ্যাসের দাম ছিল ৫৯৪ টাকা, মাস আটেকের মধ্যে সেই গ্যাস বেড়ে হয়েছে ৮৩৪ টাকা। পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়েছে আমজনতার জীবনে। একেই রোজগার নেই, তার উপরে নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসেরই দাম নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। ভাড়া বাড়ছে যানবাহনের। এই সঙ্কটকালে না খেতে পেয়ে ধুঁকছেন অসংখ্য মানুষ।
শুরুর প্রশ্নের উত্তরে আসা যাক, পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরোধিতা করে কুম্ভীরাশ্রু নিক্ষেপ করছেন বিরোধিরা। তাদের বিপ্লব ট্যুইটেই সীমাবদ্ধ। কেন্দ্র তো জানিয়েই দিয়েছে তেলের দাম তারা কমাবে না। কিন্তু রাজ্যগুলিও তাদের শুল্ক ছাটাই করবার ব্যাপারে স্পিকটি নট। বিজেপি শাসিত রাজ্য ছেড়ে দিন। অবিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিও এ ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করছে না। এমনকি কোনও রাজ্যই পেট্রোপণ্যের দামকে জিএসটির আওতায় আনার দাবিও জানায়নি সেভাবে। অর্থাৎ হাতে গরম এমন একটা টাকা রোজগারের অস্ত্রকে কেউই ভোঁতা হতে দিতে রাজি নন। তাই তো অকারণে একশো পার করা তেলের দাম, আর যে সত্তর - আশিতে নামবে না তা বলাই বাহুল্য। সরকার বদল হলেও না। ইউপিএ আমলে তেলের দাম বাড়লে এই মোদি তথা বিজেপি উচ্চস্বরে প্রতিবাদ করেছে। ক্ষমতায় এসে তারাই আজ লুটপাট চালাচ্ছে পেট্রোপণ্যের মাধ্যমে। “সত্য সেলুকাস, বিচিত্র এই দেশ।“
(www.theoffnews.com - petroleum price government India)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours