তানজিন তিপিয়া, লেখক ও রন্ধন বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ:
(ছবিটি এঁকেছেন লেখক স্বয়ং)
মস্তিষ্ক মাথার খুলিতে অবস্থান করে। প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরন বিশিষ্ট। প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের পরিমাণ ১৩০০-১৪০০ গ্রাম। বিজ্ঞানীদের মতে একজন মানুষ তার মগজ দ্বারাই সঞ্চালিত। তাকে ধরা যায়, দেখা যায়, পরীক্ষা করা যায়।
কিন্তু মনের বাস কোথায়? এর উত্তরে বিজ্ঞানীরা এখনও চিন্তায় হারিয়ে গালে হাত দেন। মন ছাড়া শুধু মস্তিষ্ক দিয়েই কি মানুষকে পরিচালিত করা সম্ভব? মস্তিষ্কতো মৃত ব্যক্তি খুলিতেও থাকে। এমন কি নেই তার যে, সে আজ একটি মস্তিষ্ক সম্পন্ন জড় জীব?
অনেক সময় মনে হয়- হয়তো আমাদের হৃদয়েই মনের বাস, বাস্তবে কিন্তু তাও নয়। মনের কোনও আবাস্থল নেই আমাদের দেহে। কিন্তু তবুও মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। কারণ তিনি সারাক্ষণ কানে ফিসফিস করেন। ভালো কাজের চেয়ে মন্দ কাজের অনুপ্রেরণা যেন তিনি একটু বেশিই দেন।
মন সম্পর্কিত ধারণা ধর্ম সর্ব যুগে সর্ব কালে কোন না কোন ধর্ম গ্রন্থরূপে স্রষ্টা আমাদের জানিয়েছেন। কিন্তু বেশ প্রচার করা হয় যে-
মন বিষয়ক চিন্তার আরম্ভ প্লেটো, অ্যারিস্টটল এবং প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের যুগ থেকে। তাদের মতে মনের উৎপত্তি স্থল মস্তিষ্কেই।
সংজ্ঞাটি বেশ অস্পষ্ট তবে মন নিজের অবস্থা এবং কাজগুলোর ক্ষেত্রে খুব জাগ্রত। মনের বৈশিষ্ট হলো মানব চেতনা। যা কারো বলায় বা দেখিয়ে দেওয়ায় আসে না। আসে আপনাআপনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে।
মন হলো চিন্তা, আবেগ এবং ভাষার সমষ্টি। তবে এখানে যে মস্তিষ্ক এবং হৃদপিণ্ডের কোন অবদান নেই তা কিন্তু নয়। শারীরের অঙ্গগুলোও সঙ্গ দিয়ে ভুমিকা পালন করে।
ধরুন এখন আপনি একদম সুস্থ কিন্তু এটি ভাবতেই মন বলে উঠবে- সুস্থ আছো তো কি হয়েছে? যেকোনও সময় অসুস্থ হয়েও তো যেতে পারো। মন ইতিবাচক কথার চেয়ে নেতিবাচক কথাই বেশি বলে বেড়ায়। তাই একে নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব জরুরী।
মনকে চেতনা প্রবাহের মতো চিত্রিত করা হয় যেখানে অনুভূতি এবং মানসিক চেতনা ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়। সাধারণত মনকে তিনটি মতবাদের শিরোনামে প্রকাশ করা যায়। অভিজ্ঞতামূলক মতবাদ- চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা-এই মানসিক কাজ গুলোর সমষ্টিগত রূপ।
আধ্যাত্মিক মতবাদ- চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা -এই মানসিক কাজগুলোর থেকে স্বতন্ত্র দেহাতিরিক্ত এক স্থান, অপরিবর্তিত আধ্যাত্মিক সত্তাকে ইঙ্গিত করে।
ভাববাদীদের মতবাদ- এক মূর্ত আধ্যাত্মিক ঐক্যের সম্বন্ধ যা চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়া ছাড়া কিছুই নয়, অথচ যা নিজের স্বাতন্ত্র্য না হারিয়ে এই সকল মানসিক কাজের ভিতর দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে।
মন এক আধ্যাত্মিক ধারণা। যা মানুষ শুধু কল্পনা করতে পারে যাকে স্পর্শ করা যায় না। মানুষ কাউকে উপলব্ধি করতে চাইলে মানুষ ভাবে সে মন থেকেই করছে। কোন বিষয়ের প্রতি সম্পর্কিত হতে হলে মানুষের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান- ধারণা বা সুখ-দুঃখ অনুভূতির প্রয়োজন হয়। যা মানুষ মন থেকে শরীরের আচরণের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। মানুষের কিছু জৈবিক চাহিদা রয়েছে। এগুলো পূরণ করার জন্য মানুষে বিভিন্ন সম্পর্কে যায় এবং নানা ধরনের আচরণ করতে থাকে।
জৈবিক চাহিদাগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্ষুধা, তৃঞ্চা, ঘুম, যৌনতা ও রেচন প্রভৃতি। এ চাহিদাগুলো যখন পূরণ হয়ে যায়, তখন মানুষ মানবিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নানারকম কার্যাবলী সম্পাদন করে থাকে। এভাবে মানুষ কখন কেন জৈবিক আচরণগুলো করে এবং তারপর কখন? কিভাবে? কেন? সে মানবিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক আচরণগুলো করা শুরু করে সেটি মানবিক পদক্ষেপ হিসেবে সুপরিচিত।
খ্রীস্টপূর্বকালীন সময় থেকেই ভিন্ন ভিন্ন সময়ের দার্শনিকেরা মনের চারিত্র্য নিয়ে বুদ্ধি খরচ করেছেন। মানব মন এবং দেহের যে সম্পর্ক তা নিয়ে দার্শনিকদের চিন্তাবলী দুটি স্রোতে বিভক্ত:
১- মন এবং দেহ পৃথক এই দ্বৈততা এবং
২- মন এবং দেহ অভিন্ন এই একসূত্রিতা।
মনের রোগ হলো সেই সমস্ত রোগ যেগুলোর অস্তিত্ব কেবল মনে অর্থাৎ শরীরে কোনো রোগ নাই কিন্তু মন খারাপ বা মনের মধ্যে দুঃখ-বেদনা, অশান্তি-হতাশা ইত্যাদির কারণে মানসিকভাবে সুস্থ নয়। ফলে শরীরের উপরও তার প্রভাব পড়ে। মনের রোগ হলে মানুষ মানসিক সমস্যায় ভোগে। এক্ষেত্রে তাকে মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়।
বিজ্ঞানের কাছে যেহেতু এই অদৃশ্য সত্তার ব্যাখ্যা নেই তাহলে তো মনোবিজ্ঞানের জন্ম নিরর্থক? কিন্তু একটি পার্থক্য অবলোকন করা যায়। বিজ্ঞানীরা আস্থায় বিশ্বাসী না হলেও সিংহভাগ মনোবিজ্ঞানীরা কিন্তু আস্থার ক্ষেত্রে কৃপণতা করেন না। তারা এই অদৃশ্য সত্তায় বিশ্বাস করেন। একজন স্রষ্টা বিশ্বাসীর মতই।
মনোবিজ্ঞান আসলে মনের বিজ্ঞান। মানুষের মন পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল যন্ত্র। যা আমাদের চিন্তা এবং আচরণের উৎস। কীভাবে রহস্যজনক এবং কঠিন এই মনকে নিয়ে অধ্যায়ন করা যায়? মনোবিজ্ঞান এই প্রশ্নটি খুঁজছে ক্রমাগত। মাথার খুলি খানা চিড়ে দেখলে শুধুই মিলবে মস্তিষ্কের ধূসর ঝকঝকে পদার্থ। কেউ যে কিছু ভাবছে, বহু স্মৃতি, আবেগ, স্বপ্ন, ধারণা, আদর্শ এসবের সন্ধান মিলবে না।
মনোবিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানীদের মতই একই পন্থায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ফলে মানুষের আচরণকেই সংক্রমণের লক্ষণ হিসেবে ব্যবহার করেন।
মন হচ্ছে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ সত্তা। যেমন ধরুন আপনি চা বানাতে গিয়ে আপনার হাত পুড়েছেন। এই দুর্ঘটনা আজীবন আপনার মনে অভিজ্ঞতারূপে জমা থাকবে। দেখবেন পরবর্তীতে আপনি যখন চা বানাতে যাবেন সেই কথাটি আপনার ঠিকই মনে পড়তে থাকবে। অতিরিক্ত ভয় ঢুকে গেলো হয়তো চা বানাতেই পারছেন না আর আপনি। এটি হয় মস্তিস্কে কর্টিসল নিঃসরণের ফলে। যখন আমরা ভয় পাই তখন এই পদার্থ মস্তিষ্কের চারপাশ ঘিরে রাখে। তো কি বুঝলেন? মনই আসলে মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রক। আপনি আর আমি মস্তিষ্কে জমা অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার থেকে অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগিয়েই সামনে এগোই।
(www.theoffnews.com - Bangladesh mind)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours