তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতায় এসে বুঝে ছিল বাংলার এই বাবু সমাজকে অনুগত করে রাখতে পারলে তাদের শাসন করতে সুবিধা হবে তাই ব্রিটিশরা বাবু কালচারকে উৎসাহ দেয়। তাদের প্রভাব ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করে| আরো নতুন নতুন উপাধি তৈরী হয় যেমন রাজা, রায়, রায় চৌধুরী, রায় বাহাদুর ইত্যাদি|
ব্রিটিশ আমলে এক নতুন অভিজাত শ্রেণীর তৈরী হলো। শিক্ষা ও বংশ পরিচয়কে ছাপিয়ে গেলো অর্থ| কেউ বা ব্যবসা করে কেউ আবার রাজ কর্মচারী হয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে রাতারাতি হয়ে গেলো বাবু। কলকাতার বাবু কালচারের তখন স্বর্ণ যুগ বলা যায়। বাবুয়ানা ও সৌখিনতা প্রায় সমার্থক শব্দ| এর কারণ বাবু হওয়ার প্রধান শর্ত ছিলো ওই সৌখিনতা। শুধু অর্থ উপার্জন নয় অর্থ ব্যয়ের প্রতিযোগিতা এ নামতে হবে| তবেই বাবু উপাধি স্বার্থক হবে এই ছিলো মানসিকতা। ব্রিটিশরা চেয়েছিল সম্পদশালী এক চাটুকার এর দল তৈরী করতে। তাই হয়েছিল। দামি গাড়ি, লক্ষ টাকার বাইজি, বিশাল বিশাল বাড়ি, পায়রা ওড়ানো, রক্ষিতাকে নিয়ে গান বাজনা করে আর মদ খেয়ে রাতের পর রাত কাটানো ছিল এই ধনী বাবু সমাজের প্রতিদিন এর জীবন।
কালী প্রসন্ন সিংহের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি সেকালের বাবুদের স্ত্রীরা কোনো রাতেই তাদের স্বামীদের মুখ দেখতো না| কারন বাবুদের প্রতিটা রাত কাটতো বাইজি বা রক্ষিতার সাথে নাচ মহলে। বঙ্কিম চন্দ্র তার বাবু নামক রম্য রচনায় লিখে ছিলেন যিনি দূর্গা উৎসব এর উদ্দেশ্য দূর্গা পুজা করবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষী পুজো করবেন, উপপত্নীর অনুরোধে স্বরূস্বতী পুজো করবেন এবং মাংস খাওয়ার লোভে পাঠা বলী দেবেন তিনিই বাবু|
শিক্ষাবিদ, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক শিবনাথ শাস্ত্রী ‘বাবু’দের সম্পর্কে লিখেছেন, ”বাবু মহাশয়েরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া, বুলবুলির লড়াই দেখিয়া, সেতার, এসরাজ, বীণা প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি, ফুল আখড়াই, হাফ আখড়াই,পাঁচালী প্রভৃতি শুনিয়া রাত্রি কালে বারাঙ্গানাদিগের গৃহে গৃহে গীত বাদ্য ও আমোদ প্রমোদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড়দহের ও ঘোষপাড়ার মেলা এবং মাহেশর স্নান যাত্রা প্রভৃতির সময়ে কলিকাতা হইতে বারাঙ্গানাদিগকে সঙ্গে লইয়া দলে দলে নৌকা যোগে আমোদ করিতে যাইতেন।”
কলকাতার বিখ্যাত আট বাবু ছিলেন।
নীলমনি হালদার।
রামতানু দত্ত।
গোকুলচন্দ্র মিত্র।
রাজা রাজকৃষ্ণ।
কালীপ্রসন্ন সিংহের পূর্বপুরুষ ছাতু সিংহ।
দর্পনারায়ণ ঠাকুর।
রাজা সুখময় রায়।
এবং চোরাবাগান মিত্র বংশের এক বাবু। এরা ছিলেন প্রধান, তাছাড়া আরো অনেক বাবু গজিয়ে উঠেছিল রাতারাতি। জোড়া সাঁকো ঠাকুর বাড়ির সদস্যরাও বাবুয়ানাতে খুব একটা পিছিয়ে ছিল না | দ্বারকানাথ ঠাকুর তার বিলাসিতা ও সৌখিনতার জন্য বিশেষ ভাবে পরিচিত ছিলেন।কিছু প্রতিভা সম্পন্ন, ব্যতিক্রমী চরিত্রের বাবুও ছিল সে সময়। যেমন আশুতোষ ও প্রমথনাথ। এঁরা যথাক্রমে সাতু (ছাতু) বাবু ও লাটু বাবু নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। আশুতোষ বাবু ছিলেন তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ সেতারিদের মধ্যে অন্যতম। লাটু বাবু যেমন ছিলেন দানশীল, তেমন ছিলেন বিলাসী। এই ছাতু বাবুর নামেই কিন্তু ছাতু বাবুর বাজার।
বাবুদের বিলাসিতা বা সৌখিনতা কখনো কখনো হাস্যকর পর্যায় পৌঁছাতো| কেউ কুকুরের বিয়েতে হাজার হাজার টাকা খরচ করছে তো কেউ পোষা বেড়ালের বিয়েতে দশটা গ্রামের লোক নিমন্ত্রণ করে খাওয়াচ্ছে। কেউ পায়রার পেছনে লক্ষ টাকা উড়িয়ে দিচ্ছে। সোনা যায় কিছু ধনী বাবু জুতোর ডগায় হিরে বসিয়ে রাখতেন| ভাবা যায়!
শোনা যায় রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র তার পোষা বাঁদরের বিয়েতে এক লক্ষের বেশি টাকা খরচ করে তাক লাগিয়ে দিয়ে ছিলেন| বানরের মাথায় ছিলো হিরে মুক্ত খচিত মুকুট। সঙ্গে বিলাস বহুল পালকি ও শোভাযাত্রা। রাজা ইন্দ্র নারায়ণ রায় তার বিড়ালের বিয়েতে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন বলে শোনা যায়| নিমাই চাঁদ মল্লিক এর নাতি রাম রতন মল্লিক এর বিয়েতে চিৎ পুরের দুমাইল রাস্তা ভেজানো হয়েছিলো খাঁটি গোলাপ জল দিয়ে। ঘোড়া গাড়িতে বাবুরা হাজার হাজার টাকা উড়িয়ে দিতো| কত রকম বাহারের গাড়ি ছিল সেকালে, ফিটন, বগি, বৃতস কাস, পালকিও হতো মহা মূল্যবান, সৌখিন, জমকালো| পরে মোটর গাড়ি উঠলে বাবুরা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে তা আনাতে শুরু করে|
মদ ছাড়াও বাবুরা সাহেবদের থেকে আরেকটা জিনিস শিখে ছিলেন তা হলো নাট্য চর্চা। আশুতোষ দেব বা ছাতু বাবু, শোভাবাজার রাজ বাড়ির বাবুরা এবং ঠাকুর বাড়ির বাবুরা নাটকে অর্থাৎ ব্যয় করলেন। এই ভাবে বাংলা থিয়েটারের ভিত্তি স্থাপন হলো। পরে গিরিশ ঘোষ এর হাত ধরে তা আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল| শুধু নাটক কেন, বাংলা গান, যাত্রা এবং পরবর্তীতে চলচ্চিত্র বাবুদের অর্থ সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সম্ভব ছিল না| সেদিক দিয়ে বাংলা শিল্প ও সংস্কৃতি জগৎ শুধু বাবুদের কাছে নয়, বাইজিদের কাছেও অনেকটা ঋণী। (সমাপ্ত)
(www.theoffnews.com - Baiji babu culture)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours