দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামির বিশ্ববিখ‍্যাত পেরোটিস আর্ট গ‍্যালারিতে প্রদর্শিত একটি ছবিতে পাকা কদলী চিপকে দিয়েছেন ইটালির শিল্পী মরিজিও কেটলান। তার মূল্য এক লক্ষ কুড়ি হাজার ডলার। তিন জন ক্রেতা মিলে ওই শিল্পকর্মটি ক্রয় করেন। কিন্তু ভাবতে পারেননি, কেউ কলাটি কেউ খেয়ে ফেলতে পারে! মিস ডাটুনা খপাৎ করে কলাটি টেনে খুলে খেয়ে সেলফি তুলে ইন্সট্রাগ্রামে পোস্ট করেন। আর্ট গ‍্যালারীর পরিচালক এর জন্য কোনো আইনী ব‍্যবস্থা নেননি। শুধু বলেন, কলাটি তো শিল্পীর ধারণা মাত্র। শিল্প কর্ম ঠিকই আছে। 

এই ধারণা আসলে শিল্পীর খেয়াল। আর সেই খেয়ালেই তো শিল্পী অবন, রবি ঠাকুর ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আসর জমাতেন। আর তার নির্মিতি ছিল জিলিপি অমৃতি। সেই খেয়ালেই অবন বলেন, “ধীরে ধীরে পথ ধরো মুসাফির, সীড়ী হৈ অধবনী!”—দুর্গম সোপান, হে যাত্রী, ধীরে পা রাখ।এ পা রাখতে গেলে পার্থিব জ্বালানি নয়, মনের জ্বালানির দরকার পড়ে।

জ্বালানির অগ্নিমূল‍্যে যখন গণপরিবহন বেসামাল, ঠিক তখনই গরীবের ঘোড়া রোগ পাঁড়ুইয়ের এক শিল্পীর। শিল্পী উদয় দাস তাঁর মা লক্ষ্মীর নামে নিজেই বানিয়ে ফেললেন "লক্ষ্মী ট্র‍্যাভেলস" বাস। শুরুতে এমন মন্তব্য গ্রামের অনেকেই করেছিলেন। অবশ‍্য যতক্ষণ না কোন রূপকথার কাহিনীর মত তার বাস সজীব হয়ে জ্বালানির তেল দাবী করছে! ততক্ষণ নো চিন্তা বাস মালিকের! এটাই যা আশার কথা!

বাসের রুট বোলপুর শান্তিনিকেতন বাইপাশ রোড। রাজ‍্য সরকারের নিয়মে করোনা বিধি মেনে পঞ্চাশ শতাংশ যাত্রী নিয়ে দূরত্ববিধি মেনে চলতে হবে বাস। বোলপুর শান্তিনিকেতন ছেড়ে কসবা পাঁড়ুই হয়ে সিউড়ী যাবে বাস। রিজার্ভ করা যাবে। কন্টাক্ট নাম্বার দেওয়া আছে বাসের গায়ে।

বাস তো হলো, কিন্তু তেলের যা দাম! তবুও এই  খেয়াল! শিল্পী মাত্রেই খেয়ালী, আর শিল্প মানেই খামখেয়ালের ফসল। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে পাঁড়ুই পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ধানাইগ্রামে যেতে হবে। পাঁড়ুই থেকে মাত্র এক কিমি হাঁটা পথ।

ব‍্যাঙ্ক থেকে আশি হাজার টাকা লোন নিয়ে একা হাতে নিখুঁত বাসের আদলে তৈরী করে ফেলেন এক আস্ত বাসা। দূর থেকে সাধারণ মানুষের মনে হবে বাস দাঁড়িয়ে আছে প‍্যাসেঞ্জার নেওয়ার জন‍্য।  পাক্কা এক বছর লাগে। তাঁকে সাহায্য করেছেন স্ত্রী আর বড় ছেলে। দুএকজন শ্রমিক ছাড়া পুরো কাজটা নিজে একা হাতে করেছেন। এমনিতে মৃৎ শিল্পী। পুরন্দরপুরে পঁয়তাল্লিশ ফুট কালি মুর্তি তিনি তৈরী করেন। পড়াশোনা করা হয়নি। তাই বিশ্বভারতীর কলাভবনে পড়ার সাধ তাঁর মেটেনি। কৃষিমেলায় তাঁর শিল্প সকলের নজর কাড়ে। পুরস্কারও পান। তবে অভাব তাঁর নিত‍্যসঙ্গী। শিল্পী ভাতা পাননি। পাননি অন‍্যান‍্য সাহায্য। 

প্রথম যখন বাসা বানাতে গিয়ে বাস বানাচ্ছিলেন, অনেকেই ভাবছিলেন একি ছেলেখেলা! আজ সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে বাস খুঁজতে সবাই চলে আসছেন, রসিকতা করে বলছেন, বাসে চড়তে এলাম। দাদা, বাস কখন ছাড়বে? সবার  তারিফ শুনে উদয় দাস বলেন, সবাইকে আনন্দ দিতে পারছি এতেই  আনন্দ। এখনো গৃহপ্রবেশ হয়নি। তবে বাইরে ওয়েদার কোট পেন্টিং, জানালার কাঁচ লাগানো সম্পূর্ণ। দূরদূরান্তের লোকের কাছে এখন পরিচিত শিল্পীর গ্রাম ধানাইগ্রাম। বাসের আদলে বাসা দেখতে ভিড় জমছে মানুষের। এখন পোড়ো ভগ্নপ্রায় বাড়িতে বড় ছেলের পরিবার, ছোট ছেলে, স্ত্রী ও অসুস্থ মা বাবাকে নিয়ে মাত্র দুটি রুমে  থাকেন উদয় দাস। দুই ছেলে ও এক মেয়ে। এক ছেলে ও মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। 

বাস বাড়ি। অথচ বাস বলে ভুল হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে। বাসের রঙ, বাসের জানালা, বাসের ঘেরা ছাদ, বাসের মুখ, হেড লাইট, বাসের চাকা এত নিখুঁত যা একমাএ কোন শিল্পীর পক্ষে এমনভাবে প্রাণবন্ত করে তোলা সম্ভব। চাকায় নাটবোল্ট পর্যন্ত আসল মনে হবে। শিল্পীর কথায়, ঢালাই দিয়ে চাকা তৈরী হয়। তারপর ছোট কুর্ণি দিয়ে সিমেন্টের মশলা ধরিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় বাসের চাকা।  শুধু তাই নয় বাসের গায়ে যেসব লেখা থাকে তাও হুবহু লেখা রয়েছে। বাসের ভেতরে ঢুকলে একটি রান্নাঘর ও একটি বেডরুম আছে। কিন্তু  রান্না ঘর পুরো বাসের কেবিন। কেবিনের দেওয়ালে শিবের মুর্তি। বাসা মনে হবে না। মনে হবে যেন বাসেই আছি। গন্তব্যস্থল চলে এলো না তো?

খালাসী যেন হাঁক মারছে-- পাঁড়ুই, কসবা, সিড়ড়ী...

কিন্তু শিল্পীর খেয়াল জমাটিয়া আসর। সেখানে অভাব নয়, নিয়ম নয়, খেয়ালটাই আসল! বাসা আর বাসের প্রভেদ থেকে একটু দূরে!

(www theoffnews.com - bus house Birbhum)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours