পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

কয়েক মাস আগেও হড়পা বানে বেশ কিছু নেতা ভেসে যাওয়ায় তৃণমূলে একটা সাময়িক নেতার অভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল। একে তো নির্বাচনে টিকিট না পেয়ে দলত্যাগ, অন্যদিকে দলত্যাগীদের দেখে অন্যদেরও কিঞ্চিৎ অস্বস্তিকর নড়াচড়া। সব দেখেই মমতা আভাস দিয়ে রেখেছিলেন জিতে এলে বিধান পরিষদ গঠন হবে। এখন সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে উদ্যোগী হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।  একেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এবার ক্ষমতায় তারা, তার উপরে চলে যাওয়া নেতাদের বড় অংশই ফের ফিরে আসার জন্য উস্খুস করছেন। পাশাপাশি এই নিয়ে বর্তমান নেতাদের উৎকণ্ঠা, ক্ষোভও যে যথেষ্ট তা বিলক্ষণ জানা আছে মমতার। তাই তো ফিরে আসা, পরাজিত এবং বিক্ষুব্ধ নেতাদের পুনর্বাসনের জন্য সব চাইতে ভাল পন্থা বিধান পরিষদ চালুর ব্যাপারে তিনি উদ্যোগী হয়েছেন।  

ছোট্ট করে একবার দেখে নেওয়া যাক এই বিধান পরিষদ আদতে ঠিক কি? সংবিধানের ১৭১ নম্বর ধারা অনুসারে, বিধানসভার সদস্য সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে পরিষদের সদস্য সীমাবদ্ধ রাখতে হয়৷ কিন্তু তা কখনোই ৪০-এর কম হবে না৷ পশ্চিমবঙ্গের বিধান পরিষদ গঠিত হলে সর্বাধিক ৯৮ জন সদস্য হতে পারবেন৷ সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ ছয় বছর৷ প্রতি দু'বছর অন্তর এক-তৃতীয়াংশ সদস্য অবসর নেবেন৷ শুধু মনোনয়ন নয়, পরিষদের সদস্যরা নির্বাচিত হবেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের ভোটে৷ বিধানসভা থেকে স্থানীয় প্রশাসনের সদস্য কিংবা স্নাতক থেকে শিক্ষক, অনেকেরই এক্ষেত্রে ভোটদানের অধিকার রয়েছে৷ অর্থ বিল বিধান পরিষদে উত্থাপন করা যায় না। বিধান পরিষদের অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা প্রায় নেই বললেই চলে। অর্থ বিল ছাড়া যে কোন বিল বিধান পরিষদে উত্থাপন করা যায়। বিধানসভায় পাশ হওয়া কোনো বিলকে বিধান পরিষদ সর্বাধিক ৪ মাস পর্যন্ত আটকে রাখতে পারে। সংবিধান অনুযায়ী, রাজ্যের মন্ত্রীসভা শুধুমাত্র নিম্নকক্ষ অর্থাৎ বিধানসভার কাছেই দায়বদ্ধ। ফলে শাসন সংক্রান্তও তেমন ক্ষমতা নেই বিধান পরিষদের। 

বিধান পরিষদ নামক সাদা হাতিটি পশ্চিমবঙ্গে আগেও ছিল। ১৯৫২ সালে বিধানসভার পাশাপাশি বিধান পরিষদও গঠিত হয়। কিন্তু ১৯৬৯ সালে বিধানসভা ও সংসদে আইন পাস করে ১৯৭০ সালের ২১ মার্চ তার অবলুপ্তি হয়। শোনা যায় সেই বিধান পরিষদের অভিজ্ঞতা খুব একট সুখকর নয়। সিংহভাগ বিলই আলোচনা না করে পাস করে দেওয়া হয়েছিল। এখনও উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র, কর্ণাটক ও জম্মু কাশ্মীরে বিধান পরিষদ আছে। কিন্তু বিধান পরিষদে আলোচনা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনও খবর হয়েছে এমন উদাহরণ বড়ই দুস্প্রাপ্য। 

বিধান পরিষদ গঠনের ক্ষেত্রে আরও একটা গল্প কাজ করছে। উদ্ধব ঠাকরে বিধানসভায় প্রার্থী ছিলেন না। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি বিধান পরিষদ সদস্য হয়েছেন। ফলে তাকে আর ভোটে দাঁড়াতে হয়নি। উত্তর প্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ বিধান পরিষদ সদস্য। তিনিও বিধানসভার ভোটে দাঁড়াননি। বিহারে নীতীশ কুমারও বিধান পরিষদের সদস্য। তিনজনেই বিধান পরিষদ থাকার সুবিধাটা নিয়েছেন। কিন্তু এ রাজ্যে বিধান পরিষদ না থাকায় সেই সুবিধা মমতা নিতে পারছেন না।

পশ্চিমবঙ্গে বিধান পরিষদ হলে তার সদস্য সংখ্যা হবে ৯৮ জন। সেক্ষেত্রে তাদের জন্য আলাদা সচিবালয়, পুরো সরকারি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ও তা চালানোর জন্য বছরে কয়েকশো কোটি টাকা খরচ হবে। সেই টাকা জনগণের পকেট থেকেই আসবে। কিছু পরাজিত বা মোসাহেব নেতা-নেত্রীকে গুরুত্বহীন বিধান পরিষদের সদস্য করার দায়টা আদতে বহন করতে হবে জনগণকেই। এই নেতা ও নেত্রীদের সরকারি পদ দেওয়ার অন্য বহু সুযোগ তো আছেই। 

তবে এটাও ঠিক রাজ্যে বিধান পরিষদ বানানো এত সহজও নয়। বিজেপি রাজি না হলে, এটা হওয়া এই মুহূর্তে অসম্ভব। বিধানসভায় পাশ হয়ে গেলেও, বিধান পরিষদ গঠনের জন্য রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সিলমোহর দরকার। সেখান থেকে কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক ঘুরে লোকসভা এবং রাজ্যসভা, সংসদের দু’কক্ষেই প্রস্তাবটি পাশ করাতে হবে। তারপর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর লাগবে। তবেই এ রাজ্যে বিধান পরিষদ চালু হবে। অর্থাৎ বিজেপি না চাইলে বিধান পরিষদের সম্ভাবনা ক্ষীণ।  বিধান পরিষদের অনুমতি না দেওয়া বাংলার প্রতি বঞ্চনার হাতিয়ার হিসাবে তুলে ধরতে পারেন মমতা। বলতেই পারেন, বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশ, কর্ণাটক, বিহারে যদি বিধান পরিষদ থাকতে পারে, তা হলে বাংলা কি দোষ করল? কিন্তু পাশাপাশি এটাও মাথায় রাখতে হবে অধিকাংশ রাজ্যেই কিন্তু বিধান পরিষদ নেই। তাদের কোনও সমস্যা না হলে এই সঙ্কটের সময় অহেতুক এতটা বাড়তি আর্থিক চাপ কয়েকজন নেতা বা মোসাহেবকে পুষতে গিয়ে নেওয়াটা কি বাস্তব সম্মত হবে?

(www.theoffnews.com - West Bengal Bidhan Parishad)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours